Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

7kআবু আহমেদ।। খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারি ২০১৭:  অনুরোধে যদি কাজ হতো, তাহলে এত দিনে অনেক বহুজাতিক কোম্পানি শেয়ারবাজারে এসে যেত। কারণ এর আগেও অল্পবিস্তর ওসব কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা তা করেনি।
২০০৯ সালে সর্বশেষ গ্রামীণফোন তার ১০ শতাংশ ইক্যুইটিকে জনগণের জন্য অফলোড করার মাধ্যমে ঢাকার শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এরপর শুনেছিলাম মোবাইল টেলিফোন খাতে ব্যবসার দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলালিংক শেয়ারবাজারে আসবে। তারা আসার জন্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কাছে সময়ও চেয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আর তারা আসেনি। আসার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কসমেটিক ও সাবান খাতের বৃহত্তম কোম্পানি ইউনিলিভারের সঙ্গে শেয়ারবাজারে আসার বিষয়ে কয়েকটি বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু বাইরের লোক জানল না কী কারণে দেশের অর্থনীতিতে অন্যতম ওই বৃহৎ কোম্পানি শেয়ারবাজারে এলো না। আজ ইউনিলিভারের শেয়ারবাজারে আসার বিষয়টি যেন ভুলে যাওয়া একটি বিষয়। ফুড সেক্টরের অন্যতম বৃহৎ বহুজাতিক কোম্পানি নেসেল। ওই কোম্পানি ভারতসহ অন্য দেশে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কিন্তু বাংলাদেশে শেয়ারবাজারে আসার ক্ষেত্রে তারা কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
বিষয়টি এমনও হতে পারে যে এই কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আসার জন্য বাংলাদেশের তরফ থেকে কোনো অনুরোধই করা হয়নি। আরো অনেক বহুজাতিক কোম্পানি আছে যেগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভালো ব্যবসা করছে, অথচ এ দেশের শেয়ারবাজারে আসার ক্ষেত্রে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এর মূল কারণ হলো, তাদের এ ব্যাপারে আমাদের সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে জোর দিয়ে কোনো দিনই কিছু বলা হয়নি। বলা হলে তারা না এসে পারত না। ইদানীং সরকারের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ারবাজারে আসার ক্ষেত্রে সভা-সেমিনারে অনুরোধ করে যাচ্ছেন। তবে সত্য হলো, শুধু সভা-সেমিনারের অনুরোধ এসব অনিচ্ছুক কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনতে পারবে না। আনতে হলে তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে হবে, দরকার হলে চোখ রাঙাতে হবে, আঙুল বাঁকা করতে হবে। আমাদের নীতিনির্ধারকদের জানতে হবে অন্য দেশের শেয়ারবাজারে ওসব বহুজাতিক কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলেও বাংলাদেশে কী কারণে তা হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে বৈঠক করলেই বিষয়টি জানা যাবে। আমার জানামতে, শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসব কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার জন্য কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠক কোনো দিনই করেনি। যা করেছে তা হলো এখানে-সেখানে দু-একটি কথা বলা বা ভাসা ভাসা অনুরোধ। এত নরম অনুরোধে যদি তারা শেয়ারবাজারে আসত, তাহলে এত দিনে এসে যেত। আমাদের সরকারকে বুঝতে হবে শুধুই অনুরোধে কোনো কাজ হবে না। শাস্তি আর পুরস্কারের দুটি পথই কাজে লাগাতে হবে এ ক্ষেত্রে। বছরখানেক আগে এক বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তা বা সিইওকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার কোম্পানি কেন শেয়ারবাজারে আসছে না? তিনি অনেকটা বিরক্ত হয়ে সাংবাদিকদের বললেন, কেন আসব? এ বাজারে আসলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি, সুবিধা থেকে অসুবিধা বেশি। সাংবাদিকরা আর এ প্রশ্ন করার সুযোগ পাননি যে বলুন তো দেখি কী কী অসুবিধা আছে শেয়ারবাজারে এলে? এতই যদি অসুবিধা হতো, তাহলে গ্রামীণফোন, বার্জার পেইন্টস, বাটা লিমিটেডসহ অন্য আরো যে কয়েকটি কোম্পানি শেয়ারবাজারে এলো, তারা কিভাবে এলো? আপনার কথা সত্য হলে তো এসব বহুজাতিক কোম্পানিও শেয়ারবাজারে আসত না। আরো সত্য হলো, ওসব কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসার কারণে ওগুলো সম্পর্কে, ওগুলোর ব্যবসার ঋণ ও লাভ-লোকসান সম্পর্কে এ দেশের জনগণ জানে। আর আপনাদের কোম্পানি, যেগুলো এ দেশে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করছে, সেগুলো সম্পর্কে এ দেশের জনগণ পুরোপুরি অন্ধকারে আছে। আপনাদের সিইওরা কত টাকা বেতন-ভাতা নিচ্ছেন, তা-ও মানুষ জানে না, আর আপনারা কত টাকা বিভিন্ন কায়দায় দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তা-ও জানে না। আপনারা কত টাকা সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছেন সেটা রাজস্ব বোর্ড জানলেও দেশের জনগণের এ ব্যাপারে কোনো ধারণা নেই। অথচ পুঁজির মাত্র ১০ শতাংশ (১০% ড়ভ ঃযব ঢ়ধরফ ঁঢ় পধঢ়রঃধষ) অফলোড করে আপনাদের কোম্পানিগুলো শেয়ারবাজারে এলে আপনাদের ব্যবসার লাভ-ক্ষতি ও ট্যাক্স প্রদান সম্পর্কে অনেক কিছু এ দেশের বিনিয়োগকারীরা, তথা জনগণ জানতে পারত।
আমি বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে এ ব্যাপারে দোষ দিই না। আমি দোষ দিই আমাদের দেশের সরকারকে। শুধু এই সরকারই নয়, আগের সরকারগুলোকেও। সরকার চাইলে কোনো কোম্পানি শেয়ারবাজারে আসবে না—এটা হতেই পারে না। এসব কোম্পানি মুম্বাই, করাচি, ব্যাংকক, কুয়ালালামপুরসহ বিশ্বের অন্য প্রায় সব স্টক এক্সচেঞ্জই তালিকাভুক্ত আছে। শুধু নেই ঢাকার স্টক এক্সচেঞ্জে। কেন নেই, এ প্রশ্নটি কি আমাদের নীতিনির্ধারকরা একবারও নিজেদের জিজ্ঞেস করেছেন। মন্ত্রী এসেছেন-গেছেন, সচিব এসেছেন-গেছেন, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এসেছেন-গেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর এসেছেন-গেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান-সদস্যরা এসেছেন-গেছেন, কিন্তু তাঁরা কোনো দিনই এসব বহুজাতিক কোম্পানির সিইওদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন না কেন, তোমরা শেয়ারবাজারে আসছ না কেন? তোমাদের কৈফিয়ত কী? আমাদের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানিগুলোকে কম ট্যাক্স দিতে হয়। সেটা হলো ১০ শতাংশের কম করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স। যে কোম্পানি বছরে ২০০ কোটি টাকার নিট মুনাফা করে, শেয়ারবাজারে এলে তাকে ২০ কোটি টাকার কম ট্যাক্স দিতে হয়। এই কম ট্যাক্স অনেক ক্ষেত্রে তাদের পেইড আপ ক্যাপিটাল থেকেও বেশি। আরো বলার বিষয় হলো, মাত্র ১০ শতাংশ ট্যাক্স জনগণের কাছে বাজারমূল্যে অফলোড করলে পুরো মুনাফার ওপরই ১০ শতাংশ করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স কম দিলে চলে।
এই প্রণোদনা আমার হিসাবে কম নয়। তবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো আরো কিছু চায় কি না সেটা তাদের জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে এ দেশের শেয়ারবাজারে আসতে হলে প্রথমেই তাদের স্থানীয় বা লোকাল সাবসিডিয়ারি হিসেবে নিবন্ধিত হতে হবে। কিন্তু সত্য হলো, অনেক বহুজাতিক কোম্পানি লোকাল সাবসিডিয়ারি না হয়ে শুধু ব্রাঞ্চ কোম্পানি হয়ে এ দেশে ব্যবসা করে যাচ্ছে। এটা কেন করতে দেওয়া হচ্ছে সেটা সরকারই ভালো বলতে পারবে। আমার মতে, টার্নওভারের একটা পর্যায় অতিক্রম করলে ওসব কোম্পানিকে লোকাল সাবসিডিয়ারি হিসেবে নিবন্ধনের আদেশ দেওয়া যেতে পারে। অন্য বক্তব্য হলো, আমার মনে হয় না বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর হেড অফিস আমাদের শেয়ারবাজারে আসার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি করবে। আপত্তি করছেন বা করবেন তাহলে এসব কোম্পানির স্থানীয় সিইওরা। তাঁদের কাছে এ বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়; যেমন গুরুত্বপূর্ণ তাদের ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ও বৃদ্ধি দেখিয়ে প্রমোশনসহ আরো অধিক বেতন-ভাতা গ্রহণ করা। তাঁরা ব্যস্ত তাঁদের হেড অফিসের বসদের খুশি করতে। এ দেশের জনগণকে তাঁদের কোম্পানির ১০ শতাংশ মালিকানা দিলে যে এ দেশের জনগণের অনেক উপকার হয়, সে নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। এ নিয়ে মাথাব্যথা থাকতে হবে আমাদের সরকারেরই। আজকে যদি বছরে একটি বহুজাতিক কোম্পানিকেও শেয়ারবাজারে আনা যায়, তাহলে সেটা হবে সরকারের জন্য বড় সাফল্য। কোনো দেশের শেয়ারবাজারের গুণ বা শেয়ারবাজারের উপযুক্ততা কত কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আছে, তা দিয়ে বিচার করা হয় না। বিচার করা হয় কত মানসম্পন্ন কোম্পানি শেয়ারবাজারে আছে তা দিয়ে। মানসম্পন্ন কোম্পানি শেয়ারবাজারে বেশি থাকলে জনগণ দীর্ঘমেয়াদের জন্য বিনিয়োগ করে ওসব কোম্পানির শেয়ারে। আর দুর্বল কোম্পানি দ্বারা শেয়ারবাজার ভর্তি থাকলে তখন শেয়ারবাজার জুয়াড়িদের ক্যাসিনো হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
শেয়ারবাজারকে যদি জনগণের জন্য অংশগ্রহণমূলক করতে হয়, তাহলে ভালো শেয়ারের জোগান দিতে হবে। গত কয়েক বছরে শেয়ারবাজার থেকে অনেক অর্থ বের হয়ে গেছে। এই বের হওয়ার ক্ষেত্রে এক বড় ভূমিকা পালন করেছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কয়েকজন উদ্যোক্তা। তারাই লাখ লাখ শেয়ার বেচে দিয়েছে, আর তাদের কোম্পানিগুলো যদি শেয়ারবাজারে না এসে প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি থাকত, তাহলে এত সহজে তারা শেয়ার বেচে এত তাড়াতাড়ি এত ধনী হতে পারত না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এ ক্ষেত্রে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে যেন অনেক বেশি উদার। কী অসুবিধা ছিল লিজিংয়ের তারিখ থেকে তিন বছরের জন্য উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রয়ের ওপর খড়পশ-ওহ দিলে?
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[সংকলিত]