গাজীউল হাসান খান ।। খােলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭: এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি-প্রকৌশল ও সামরিক দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্র অনেক উন্নত ও শক্তিশালী।
আর সে দেশের সঙ্গেই রয়েছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বৈদেশিক বাণিজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল জনসংখ্যার খুব কম মানুষই আছে, যারা এখনো বাংলাদেশের কোনো না কোনো তৈরি পোশাক পরেনি। আগামী ২০২০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের বর্তমান বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। সুতরাং সংগত কারণেই শুধু রাজনীতিক কিংবা কূটনীতিক মহলেরই নয়, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়েরও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা অনেক বেশি। তা ছাড়া সচেতন ও উৎসাহী, প্রায় সবারই মার্কিন ডলার থেকে ডেমোক্রেসি ও হলিউড থেকে ক্যাপিটল হিল এবং বিশেষ করে তাদের ন্যাশনাল পলিটিকস থেকে ন্যাশনাল ইলেকশনের প্রতি একটি অন্তরঙ্গ দৃষ্টি থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন যেন বিশ্বের নির্বাচন। কারণ রাশিয়ার নেতৃত্বে বলশেভিক বিপ্লবের পর সোভিয়েত পদ্ধতির বিপক্ষে তথাকথিত মুক্ত বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। তা ছাড়া সব কিছুতে মার্কিনিদের জৌলুস ও চৌকস জীবনযাত্রা যেন সবাইকে অলক্ষ্যে কাছে টানে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিগত প্রায় ২৫০ বছরের সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার পর আজ তারা জাতীয়ভাবে একটি অনুকরণীয় টেকসই বা এককথায় স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পৌঁছেছে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত পক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে কোনো বিবাদ-বিসংবাদের মুখোমুখি হতে হয়নি। আইনের শাসন কিংবা মানবাধিকারের প্রশ্নে রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পর্যন্ত সেখানে জাতীয় নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তেমন কোনো কথা ওঠেনি বা বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নির্বাচিত প্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট, যিনি আফ্রিকান-আমেরিকান হয়েও আপামর জনগণের বিপুল ভোটে পর পর দুই দফা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের সময় থেকে বারাক ওবামা পর্যন্ত দু-একটি ছোটখাটো ঝামেলা ছাড়া সাংবিধানিক কিংবা নির্বাচনীব্যবস্থা নিয়ে বড় কোনো বিতর্ক দেখা দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজনীতিতে এসেছেন প্রধানত আইন পেশা থেকে। সে পেশা থেকেই তাঁদের অনেকে নিজ নিজ রাজ্যের আইনসভা কিংবা তার প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। কেউ বা অতীতে কোনো রাজ্যের গভর্নর নতুবা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট কংগ্রেসের সিনেট কিংবা প্রতিনিধি পরিষদে যোগ দিয়েছেন নির্বাচিত হয়ে। তা ছাড়া কেউ কেউ ভিন্ন পেশা থেকে এলেও রাজনীতি কিংবা উচ্চতর প্রশাসনের সঙ্গে তাঁদের নিবিড় যোগাযোগ ছিল। এ ক্ষেত্রে এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তি হচ্ছেন নিউ ইয়র্কের ‘ইয়্যাংকি কালচারে’ মানুষ হওয়া ব্যবসায়ী ডোনাল্ড জে ট্রাম্প, যাঁর রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক কোনো পদেই কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তিনি রিপাবলিকান পার্টির (রক্ষণশীল) প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হলেও এ দলে ছিলেন অনেকটাই বহিরাগতের মতো। চারিত্রিক গুণাবলির দিক থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকটাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, একগুঁয়ে বাগাড়ম্বরপূর্ণ ও দাম্ভিক ধরনের মানুষ বলে অভিহিত হয়েছেন বিভিন্ন গণ ও সামাজিক মাধ্যমে। তাঁর বিরুদ্ধে সর্বস্তরে শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্য বজায় রাখা কিংবা একধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদের অভিযোগ উঠেছিল নির্বাচনের বহু আগে থেকেই। তিনি হিস্পানিক, বিশেষত মেক্সিকান অবৈধ বহিরাগত, লাতিনো ও অশ্বেতাঙ্গ মানুষের বিরুদ্ধে আমেরিকান শ্বেতাঙ্গদের উসকানিমূলকভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছেন ভোটে জয়লাভ করার উদ্দেশ্যে। তিনি উল্লিখিত এ জনগোষ্ঠীকে দায়ী করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া ও তাদের ভোগান্তি বা বিপর্যয়ের জন্য। শুধু তা-ই নয়, ট্রাম্প তাঁর ভাষায়, মার্কিন উদার মনোভাবাপন্ন রাজনীতিক, লগ্নিপুঁজির ব্যাংকিংব্যবস্থা, সরকারের বাণিজ্যনীতি ও এমনকি বিভিন্ন আঞ্চলিক জোট গঠনকে সমালোচনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অধঃপতনের জন্য। তিনি প্রায় সব প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকেই ভেঙে দিতে চান। গড়ে তুলতে চান এক নতুন ব্যবস্থা, যার অভিজ্ঞতা তাঁর নিজের কিংবা এরই মধ্যে বাছাই করা মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের প্রত্যক্ষভাবে কারোরই নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভাষায়, ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কাজ না করেও নিজেকে ভাবেন সর্ব বিষয়ে পারদর্শী ও সবচেয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি। তাই তথ্যাভিজ্ঞ মহলের আশঙ্কা, ট্রাম্পের এ চমক দেওয়ার কৌশল কত দিন স্থায়ী হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার পেছনে মস্কো ও সরাসরি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হাত রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রব্যাপী গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনীব্যবস্থা হ্যাক করা কিংবা ‘সাইবার কারসাজি’র জন্য প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাশিয়াকে দায়ী করেছেন। সে কারণেই তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩৫ জন রুশ কূটনীতিকসহ অন্য আরো কয়েকজন ব্লগারকে ৭২ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে বহিষ্কার করেছেন। এ বিষয়টি ডোনাল্ড ট্রাম্প না মানলেও এটি এখানেই থেমে থাকবে বলে মনে হয় না। তবে এ বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কত দূর গড়াবে তা-ও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। বাংলাদেশে একটি প্রবাদ অত্যন্ত প্রচলিত আছে আর তা হচ্ছে, ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ‘ এখানে পক্ষপাতহীনভাবে একটি কথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা যায় যে গত আট বছরে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি গড়ে তুলেছিলেন। বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তি হিসেবে তিনি কখনোই যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণকে মেনে নেননি। তা ছাড়া ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই ওবামা আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে পর্যায়ক্রমে তা কার্যকর করেছিলেন। ইরাক আক্রমণের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে যে ধস নেমে এসেছিল, ওবামা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও দক্ষ হাতে তা সামাল দিয়েছেন। তিনি উল্লেখযোগ্য সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মহামন্দা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন। যুক্তরাষ্ট্রের বিপন্ন গাড়ি শিল্প ও অন্যান্য বন্ধ হয়ে যাওয়া উৎপাদনশীল শিল্প-কারখানা সাফল্যজনকভাবে চালু করে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেন। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের দুই কোটি অত্যন্ত দরিদ্র মানুষের জন্য সেই নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থায় ‘ওবামা কেয়ার’ নামে একটি স্বাস্থ্যসেবা চালু করেছিলেন, যা পূর্ব ঘোষণা দিয়েও সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কংগ্রেসে তাঁর ডেমোক্রেটিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার কারণে ওবামার পক্ষে সে স্বাস্থ্যসেবার আরো সংস্কার ও অন্যান্য জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সে কথা বারাক ওবামা তাঁর সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন। তা ছাড়া কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃ প্রতিষ্ঠা ও সাফল্যজনকভাবে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক ক্ষেত্রে চুক্তি সম্পাদন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ওবামার বিশেষ অবদান হিসেবেই ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে। এসব নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যত লাফালাফিই করুন, তা শুধু তথাকথিত মার্কিন শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও ইসরায়েলের ইহুদিবাদীদের খুশি করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। মার্কিন সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে সরাসরি সিরিয়া আক্রমণের পক্ষে ছিলেন না ওবামা। এ জটিল ও পরস্পরবিরোধী সম্প্রদায়ের গৃহযুদ্ধে তিনি সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিরিয়ার স্বৈরশাসককে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে রাশিয়া ও ইরানের ন্যক্কারজনক পদক্ষেপকে নিন্দা জানিয়েছেন ওবামা। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায়লগ্নে তিনি কোনো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়াতে চাননি, যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে মোড় নিতে পারত বলে অনেকে আশঙ্কা করেছেন।
যেসব আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি ক্ষমতায় গিয়েই বাতিল করতে চাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সেগুলোর সংস্কার সাধনের কথা বহু আগে থেকেই বলে আসছিলেন। তাঁর (ওবামার) ডেমোক্রেটিক দলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে ‘নাফটা’ ও এশিয়া-প্যাসিফিক বাণিজ্য চুক্তি ও ব্যবস্থায় ব্যাপক রদবদলের উল্লেখ ছিল। ডেমোক্র্যাটদের দপ্তরে (উঘঈ) রাশিয়ার সাইবার পাইরেসির কারণে হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী ঘোষণার অনেক কিছুই ট্রাম্পের শিবির অগ্রিম পেয়ে গিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। ট্রাম্পের নির্বাচনী দপ্তর থেকে হিলারির সব গোপন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ত্বরিত পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অথচ ট্রাম্পের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে তাঁর রিপাবলিকান পার্টির কোনো প্রকাশ্য অঙ্গীকার বা সমর্থন ছিল না। রিপাবলিকান পার্টির অনেক প্রভাবশালী নেতানেত্রী, এমনকি কয়েকজন সাবেক প্রেসিডেন্টও ট্রাম্পকে ভোট দেবেন না বলে অগ্রিম ঘোষণা দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো জনমত জরিপে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা উল্লেখ করার মতো ছিল না। হিলারি ক্লিনটন সর্বত্রই ৫ থেকে ১০ শতাংশ অগ্রবর্তী ছিলেন ট্রাম্পের তুলনায়। তাহলে বিশাল মাপের এক কারসাজি ছাড়া ট্রাম্প পাস করেন কিভাবে? এ প্রশ্ন এখনো যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মহলে নীরবে-নিভৃতে ভেসে বেড়াচ্ছে। এ কথা ঠিক যে নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস ও শিকাগোর মতো বড় বড় মহানগরীতে ডোনাল্ড ট্রাম্প হিলারির তুলনায় অনেক ভোট কম পেয়েছেন। তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট ছোট রাজ্য বা শহরে বসবাসকারী বিক্ষুব্ধ শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের ভোটের জোরেই কী ইলেকটোরাল কলেজে প্রধান্য পেয়েছেন ট্রাম্প?
২০ জানুয়ারি আসতে আর বেশি দিন বাকি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড জে ট্রাম্প। কিন্তু ওপরে উল্লিখিত অজস্র প্রশ্নের মুখে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়োল্লাস সত্যিকার অর্থে সাধারণ মানুষের মনে কতটুকু আনন্দ বয়ে আনতে সক্ষম হবে? ট্রাম্পের তুলনায় হিলারি প্রায় ২৪ লাখ জনপ্রিয় ভোট বেশি পেয়েছেন। তবুও বিচিত্র এক সাংবিধানিক নিয়মের কারণে ক্ষমতার মুখ দেখতে ব্যর্থ হলেন হিলারি ক্লিনটন, বিফল হলো তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থকদের সব প্রচেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্রের হেরে যাওয়া এ মানুষগুলো রাশিয়া ও তার নেতা ভ্লাদিমির পুতিনকে এখন কিভাবে নেবেন? এসব প্রশ্ন এখন প্রায় সবার মুখে মুখে। ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে দেশের বড় বড় প্রভাবশালী পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল নিশ্চিত ছিল হিলারি ক্লিনটনের বিজয়ের ব্যাপারে। কিন্তু নির্বাচনের দিন অদৃশ্য এক কারসাজির কারণে শেষ পর্যন্ত যা ঘটে গেল, গণমাধ্যম তা এখনো নিশ্চিত করতে পারছে না। এ ব্যর্থতা কার? সিআইএসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলো কী নিয়ে ব্যস্ত ছিল সে সময়? সেসব ঘটনা নিয়ে এখনো পরিষ্কারভাবে কথা বলছে না তারা। কেউ কেউ বলে, তাদের ওপর ট্রাম্পের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে।
মনে পড়ে ভ্লাদিমির পুতিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা। ফল প্রকাশের পর রাশিয়ার রাজধানী মস্কো ও সেন্ট পিটার্সবার্গসহ অন্যান্য বড় শহর-নগরে সেদিন ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে বিরোধী দলগুলো রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ করছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সেদিন প্রকাশ্যে বলেছিলেন, রাশিয়ার নির্বাচনে ব্যাপক প্রযুক্তিগত কারচুপি হয়েছে। তার প্রতিবাদে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছিলেন, তিনি হিলারির উক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন। অর্থাৎ এর বিরুদ্ধে তিনি প্রতিশোধ নেবেন। আমি তখন পারিবারিক একটি কাজে ওয়াশিংটন ডিসির পাশে ভার্জিনিয়ায় অবস্থান করছিলাম। এ বিষয়টি নিয়ে আমার বন্ধুমহলে তখন এক সরস বিতর্কের সূচনা হয়েছিল। তারপর বারাক ওবামার দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ও আমি যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিত ছিলাম। বেশ কয়েকটি নির্বাচনী প্রতিবেদনও পাঠিয়েছিলাম কালের কণ্ঠ’র জন্য। কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের হিলারির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার শপথের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তখন থেকে চার বছর পর একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী মহিলা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হলেন হিলারি ক্লিনটন। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। নির্বাচনের সময় যুক্তরাষ্ট্রে আবার বেড়াতে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিল বেড়ানোর পাশাপাশি নিউ ইয়র্ক থেকে কালের কণ্ঠ’র জন্য কিছু প্রতিবেদন পাঠাব। ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনসহ বিভিন্ন কাজে বহু বছর আমি যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছি। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও নির্বাচনীব্যবস্থার ওপর আমার যথেষ্ট আস্থা ও শ্রদ্ধা জন্মে। সে ব্যবস্থাকে আমার কাছে অত্যন্ত শক্তিশালী ও টেকসই মনে হয়েছিল সেদিন। কিন্তু হিলারি ক্লিনটনের পরাজয়ের পর আমার সে বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। মনে হয়েছে উচ্চ প্রযুক্তির সাহায্যে যেকোনো অঘটন ঘটানো সম্ভব। তবে আবার উচ্চ প্রযুক্তির সাহায্য সম্ভাব্য দুর্বল প্রবেশপথগুলো বন্ধ করাও সম্ভব। তার জন্য প্রযুক্তিবিদ ও ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলোরও যথাযথ প্রস্তুতির প্রয়োজন। ডোনাল্ড ট্রাম্প কিংবা ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে আমার কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ, ক্ষোভ বা শত্রুতা নেই। তবে হিলারি ক্লিনটন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনীব্যবস্থার ওপর যে অনৈতিক হস্তক্ষেপ বা হামলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারই তা প্রকাশ করেছে। তাতে ট্রাম্পের বিজয় অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যে যত কথাই বলুক, একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে জনগণের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা যে বেশ কমেছে, তাতে সন্দেহ নেই। শুধু তা-ই নয়, এ বিষয়টি শেষ পর্যন্ত যে কত দূর গড়াবে তা-ও এখন নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছে না।
লেখক : ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক মিনিস্টার (প্রেস ও তথ্য) এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক