Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

10kড. মাহবুব হাসান ।। খােলা বাজার২৪, বুধবার, ২৫ জানুয়ারি ২০১৭: ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বরের নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আবারও বিতর্কের ঘূর্ণিতে পড়েছে মার্কিনি গণতন্ত্র। বিশেষ করে নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন স্খলিত চরিত্রের মানুষকে মার্কিনি ভোটাররা নির্বাচিত করল কিভাবে। যিনি দেশটিকে চালাবেন তাঁর প্রশাসন দিয়ে, তাঁর নৈতিক চরিত্র যদি খারাপ হয়, তাহলে তিনি দেশ ও জাতির নেতৃত্ব কিভাবে দেবেন? আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেবল তাঁর দেশেরই নন, একই সঙ্গে তিনি বিশ্বের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক প্রশাসনগুলোরও ‘মোড়ল’ হিসেবে কাজ করে থাকেন। ফলে তাঁর নির্বাচিত হওয়াটা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সাধারণ শিক্ষিত মানুষকে। ১. একজন স্খলিত চরিত্রের মানুষকে ভোটাররা নির্বাচিত করল কোন বিবেচনায়। ২. একজন বর্ণবাদীকে কিভাবে তারা বেছে নিল। ৩. আসলেই কি ভোটাররা তাঁকে বেছে নিয়েছে? নাকি নির্বাচনী সিস্টেমের কারণে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন বলে ধরা হবে? ৪. এবারকার মার্কিনি নির্বাচনব্যবস্থায় হ্যাকিংয়ের অভিযোগ উঠেছে। রাশিয়ার হ্যাকাররা এবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে হ্যাকিং করে ভোট চুরি করেছে। অর্থাৎ হিলারির বাক্সে পড়া ভোট তারা চুরি করে ট্রাম্পের পক্ষে নিয়ে গেছে। এই অভিযোগ খোদ সিআইএ, এফবি আই ও দেশের সিকিউরিটি সংস্থা উত্থাপন করেছে। ট্রাম্প এসব অভিযোগ অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করলেও এ নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে গোয়েন্দাদের কাছে ট্রাম্প বলেছেন, রাশিয়া ও চীন সব সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাইবার আক্রমণ চালায়। নির্বাচনের সময়ও তারা তা করেছে বলে মনে হয়। অর্থাৎ পরোক্ষে তিনি স্বীকার করেছেন যে হ্যাকিং হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্নটি নিয়ে অনেকটাই তোলপাড় চলছে দেশের বিভিন্ন স্টেটে। তারা এমনও বলেছে যে তারা আর যুক্ত থাকতে চায় না এ দেশের সঙ্গে। কিন্তু ফেডারেল ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়া অতটা সহজ নয় বলেই হয়তো তারা বলেছে ইলেকটোরাল কলেজ সিস্টেম নয়, তারা ভোট দেবে পপুলার ভোটের প্রার্থীকে। এবার ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন ডেমোক্র্যাট হিলারি ক্লিনটন। তিনি ট্রাম্পের চেয়ে ২২ লাখ ভোট বেশি পেয়েছেন। তার পরও তিনি নির্বাচিত হতে পারেননি। কারণ ওই ইলেকটোরাল কলেজ সিস্টেমের কারণে। আজ বলা হচ্ছে, গণতন্ত্রের সঙ্গে এই সিস্টেম খাপ খায় না। যখন এই সিস্টেম সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল সেই ১৭৮৭ সালে, তখনকার পরিপ্রেক্ষিত আর আজকের পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে যে অনেক তফাত, তা অনেক মার্কিনি বুঝতে পারলেও এখানে হাত দিতে চায়নি বা চায় না। কেন তারা চায় না, তার মানসিক বিশ্লেষণে না গিয়েও বলা যায় এই সিস্টেমের ভেতর দিয়ে তারা একটি বিশেষ সুবিধাকে প্রাধান্য দিতেই তা মেনে চলেছে। এবারও কি সেটাই দেখা গেল না? এ কারণেই ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়াসহ ১১টি স্টেট আইন প্রণয়ন করে বলেছে, এবার থেকে পপুলার ভোট যিনি পাবেন তাঁকেই তাঁরা ভোট দেবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় এখনো অস্পষ্ট, তা হলো সেই পপুলার ভোটের ক্রাইটেরিয়া কী? সেটা কি গোটা দেশের মধ্যে যিনি বেশি ভোট পাবেন, তাঁকে দেবেন? নাকি যিনি যে স্টেটে বেশি ভোট পেয়েছেন তাঁকে দেবেন? যদি দ্বিতীয়টি হয়, তাহলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কথা বলা তো ঠিক হচ্ছে না। তিনি তো বেশির ভাগ স্টেটেই বেশি ভোট পেয়েছেন। সমগ্র দেশের ভোটে তিনি কম পেয়েছেন। আমেরিকান গণতন্ত্রে আরো একটি লিগ্যাসি হচ্ছে, কোনো স্টেটে যিনি বেশি ভোট পাবেন, তাঁর পক্ষেই গোনা হবে ওই স্টেটের সব ইলেকটোরাল ভোট। মানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোটগুলোও চলে যাবে বিজয়ীর পকেটে। ধরা যাক, ডোনাল ট্রাম্প একটি স্টেটে ভোট পেয়েছেন ৫০.১০ শতাংশ, আর হিলারি পেয়েছেন ৪৯.৯০ শতাংশ। মাত্র দশমিক ২০ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে তিনি প্রদত্ত ভোটের ১০০ শতাংশই দখল করে নিলেন। এটা তো কোনো গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতি হতে পারে না। যে ৪৯.৯০ শতাংশ ভোটার হিলারিকে ভোট দিয়েছে, তাদের ভোট প্রদানের অধিকার হরণ করা হলো। প্রদত্ত ভোট সাংবিধানিক পদ্ধতির কারণে প্রতিদ্বন্দ্বীর পকেটে চলে যাবে, এটা কোনো যুক্তিসংগত পদ্ধতি হতে পারে না, গণতান্ত্রিকও নয়। একজনকে প্রদত্ত ভোট অন্যের নামে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে নামীয় গণতন্ত্রে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা। এই পদ্ধতি বাতিল করা না হলে আমেরিকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে গণমানুষের তন্ত্র বলা হাস্যকর। আমাদের দেশেও গণতান্ত্রিক রীতি-পদ্ধতির মধ্যে মারাত্মক খুঁত রয়ে গেছে। সব কনস্টিটিউন্সির ভোটার সংখ্যা সমান নয়। ফলে কোনো আসনে একজন প্রার্থী ৯০ হাজার ভোট পেয়েই নির্বাচিত হলেন, আরেকটিতে এক লাখ ৯০ হাজার ভোট পেয়েও হেরে গেলেন প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে। সব কনস্টিটিউন্সিতে যিনি বেশি ভোট পাবেন, তিনিই নির্বাচিত বলে গণ্য হবেন। এখানেও পপুলার ভোট আমলে নেওয়ার পদ্ধতি নেই। ৩০০ আসনে যাঁরা নির্বাচন করবেন তাঁদের সবার ভোট গণনা করে ফল প্রকাশ করা হবে। যে দলটি বেশি ভোট পাবে আর যে দলটি দ্বিতীয়, যে দলটি তৃতীয় বা চতুর্থ হলো তাদের ভোটের রেশিও হিসেবে সদস্য নির্বাচিত হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে কেবল ঠিক করা হবে (যে দল সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে) তাঁরা কোন কোন আসন নিজেদের রাখবেন। বাকি আসনগুলো এভাবেই বণ্টিত হবে। এতে করে অনেক ভালো দলের অযোগ্য বা সন্ত্রাসীদের জাতীয় সংসদ থেকে দূরে রাখা যাবে। এ নিয়ে আলোচনা হলে এর আরো ভালো সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে বলে আমার ধারণা। ধরা যাক, আওয়ামী লীগ ভোট পেল ৩৩ শতাংশ আর বিএনপি পেল ৩২ শতাংশ, জাতীয় পার্টি পেল ১০ শতাংশ এবং অন্যান্য ছোট দল যারা ৫ শতাংশের কম ভোট পেল, তাদের কোনো সদস্য নির্বাচিত বলে গণ্য হবে না। এখানে সরকারে যাবে আওয়ামী লীগ ১৪০টি আসন নিয়ে আর বিএনপি ১৩৯টি আসন নিয়ে যাবে বিরোধী বেঞ্চে। বাকিরাও সেই হিসাবেই সংসদে আসন পাবে। এটা করা হলে জনগণের প্রতিনিধিত্ব হবে ব্যাপকভাবে।
আমেরিকান গণতন্ত্রেও এই পদ্ধতি আরোপিত হলে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে বলে আমার ধারণা।
কম ভোট পেয়েও আমেরিকায় পাঁচজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন কেবল ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতির কারণে। ১৮২৪ সালে জন কোয়েন্সি, তিনি ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ন্যাশনাল রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচিত হলেও সেই পার্টিই বর্তমান গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি বা রিপাবলিকান পার্টি। ১৮৭৬ সালে র‌্যাদারফোর্ড হাইস, ১৮৮৮ সালে বেঞ্জামিন হ্যারিসন, ২০০০ সালে জর্জ ডাব্লিউ বুশ ও ২০১৬ সালে হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ২২ লাখ ভোট বেশি পেয়েও হিলারি ক্লিনটন বিজয়ী নন। মাইনরিটি পিপলের প্রতিনিধি হয়ে যিনি ক্ষমতায় গেলেন, তিনি মেজরিটি পিপলের কথা চিন্তা করবেন না। কারণ তাঁর মনের ভেতরে এটাই খচ খচ করে গাঁথবে, মেজরিটি ভোটার তাঁকে ভোট দেয়নি। তাই তিনি কেবল রিপাবলিকানদের নিয়েই মত্ত থাকবেন বলে ধারণা করা যায়। আর তিনি তাঁর ব্যবসার ব্যাপারেও থাকবেন মনোযোগী। যদিও বলেছেন, তিনি ব্যবসা থেকে অবসরে যাবেন বা গেছেন। অর্থের নেশা যে কী সেটা কিন্তু পৃথিবীর ধনীদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এ নিয়ে অক্সফাম একটি রিপোর্ট করেছে যে পৃথিবীর ৩৬০ কোটি মানুষের হাতে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তার চেয়ে বেশি সম্পদ আছে মাত্র আটজন ধনীর হাতে। ৭৫ বিলিয়ন ডলার সম্পদ নিয়ে তালিকার শীর্ষে আছেন বিল গেটস। ট্রাম্প অতটা ধনী না হলেও তাঁর রয়েছে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নিজস্ব বিমান। তাহলেই বুঝুন এই ব্যবসায়ীর অর্থের লোভ কতটা হতে পারে। তাঁর প্রশাসনে বেশির ভাগই কট্টরপন্থী এবং ধনিক শ্রেণির মানুষ। আর এ দেশের মানুষ জানে, রিপাবলিকান পার্টি ধনীদের দল। গরিব ও মধ্যবিত্তের মানুষ তাই ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে। তবে এবার আমেরিকার গ্রামের সাদা মানুষ ট্রাম্পের বর্ণবাদিতায় সায় দিয়েছেন তুলনামূলকভাবে বেশি। তাঁর এই বর্ণবাদিতার কারণে দেশটির যে অসাম্প্রদায়িক চেহারা ও চরিত্র ছিল, সেখানে কালো দাগ পড়তে যাচ্ছে। ইমিগ্র্যান্টদের দেশ বলে খ্যাত আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে তাই মানবতাবাদীদের উদ্বেগের শেষ নেই।
লেখক : আমেরিকাপ্রবাসী কবি, সাংবাদিক