অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ ।। খােলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারি ২০১৭:অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রফেসর এম আদিল খানের ছোট্ট Action on Ongoing Repression of MyanmarÕs Muslims`— মানবতার যে করুণ আর্তস্বর বিশ্বময় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত ও তা যে অমার্জনীয় ঔদাসীন্যের সঙ্গে নোংরা রাজনীতির কবলে পড়ে বিশ্বমানবের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তার এক বিবরণ চিত্রিত হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
কোনো মহল থেকে তার প্রতিকারের বিন্দুমাত্র উদ্যোগ এখন পর্যন্ত গৃহীত হতে দেখা গেল না। ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিপিবদ্ধ হয়েছে : ‘মিয়ানমারের ইরাওয়াদ্দী উপত্যকায় থনটন গ্রামের প্রবেশপথে লিখিত রয়েছে, ‘এখানে কোনো মুসলিমের জন্য রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ। এখানে কোনো মুসলমান ঘর ভাড়া করতে পারবে না। এখানে কোনো মুসলমানকে কোনো বার্মিজ মেয়ে বিয়ে করতে পারবে না। আল জাজিরার রিপোর্ট অনুযায়ী, সমগ্র মিয়ানমারে সামরিক কর্মকর্তারা মুসলিমদের উচ্ছেদ, নির্বিচারে লুটপাট, মুসলিম মহিলাদের ধর্ষণ, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার মচ্ছব শুরু করেছে। ইধহশড়শ চড়ংঃপত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সে ক্যা (ঝযবু কুধ)গ্রামে সৈনিকরা অস্ত্রের মুখে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, সম্পদ লুট করেছে, মহিলাদের ধর্ষণ করেছে এবং গ্রাম থেকে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। ‘
মিয়ানমার সরকার এই অন্যায় অত্যাচার, অমানবিক নির্যাতন, পাশবিক ও ঘৃণ্য অপরাধ দেখেও দেখে না। বরং তারা এ ধরনের জঘন্য ও পাশবিক কর্মে এক প্রকার সমর্থন জোগাচ্ছে এই অজুহাতে যে ৪০০ জন বিদ্রোহী রোহিঙ্গা ৯ জন পুলিশের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে এবং তাদের হত্যা করেছে। এই অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে সরকার তদন্ত করে অন্যায়কারীদের শাস্তির বিধান করতে পারত। এই অজুহাতে রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গামুক্ত করার এই হীন প্রচেষ্টা কেন? এই অপকর্মে সরকার ধর্মীয় নেতা ও বার্মিজ তরুণদেরও উদ্যোগী করে তুলেছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের এটি ভাগ্যের এক পরিহাস বলে মনে হয়। ইতিহাসের অনেক সংকটময় মুহূর্তে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বার্মিজদের সম্মুখ কাতারের সৈনিক হিসেবে যুদ্ধ করেছে। ১৯৪৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করলেও বার্মা তখনো স্বাধীন হয়নি। বিভিন্ন আন্দোলনে রোহিঙ্গাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গৌরবজনক। এমনকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ প্রান্তে জাপান বার্মা দখল করলে জাপানের দখলমুক্ত করার সংগ্রামেও রোহিঙ্গাদের সাহস ও শৌর্য ছিল উল্লেখযোগ্য। অং সান, যিনি বার্মার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় নেতা ছিলেন (অং সান সু চির বাবা) তাঁর সঙ্গে একত্রে বার্মার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন রোহিঙ্গা নেতা ইউ রাজ্জাক। অং সান যখন বার্মার শীর্ষ নেতা ছিলেন, তখন ইউ রাজ্জাক শিক্ষা দপ্তরের দায়িত্ব নিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।
এই সংকটকালে সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপক অং সান সু চি একসময় তিনি চিহ্নিত হতেন স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বর রূপে। বর্তমানে তিনিই মিয়ানমার সরকারপ্রধান। তিনিও একসময় নির্যাতিত হয়েছেন সে দেশের সামরিক জান্তা কর্তৃক। তিনি থেকেছেন নির্বাসনে। সেই তিনি রোহিঙ্গাদের অমানবিক নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড, লুটপাট, ধর্ষণ সম্পর্কে নির্বাক। মুসলিম বিশ্বের আন্তর্জাতিক সংস্থা-ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার ওআইসির না আছে কোনো সদিচ্ছা, না আছে সুসংহত কোনো উদ্যোগ গ্রহণের কোনো দক্ষতা। এর সদস্যরা ব্যস্ত রয়েছে আত্মকলহে এবং নিজেরাই নিজেদের রক্তক্ষরণে।
তথাকথিত মুক্তবিশ্বের বেশ কিছু রাষ্ট্র, যারা মানবাধিকার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকে কেন্দ্র করে ধর্মযুদ্ধে যাওয়ার জন্য সদাপ্রস্তুত বলে মনে হয়, তারাও রয়েছে নিশ্চল আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভূ-রাজনৈতিক গতিসূত্রের নির্বন্ধে (মবড়-ঢ়ড়ষরঃরপধষ ফুহধসরপং)। নীতির পরিবর্তে আত্মস্বার্থই তাদের কাছে মুখ্য। পাশ্চাত্যের বহু শক্তিমান রাষ্ট্র আগামী দিনে দৈত্যের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসা চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশলের (ঈযরহধ ঈড়হঃধরহসবহঃ ঝঃৎধঃবমু) অংশ হিসেবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে খেপাতে চায় না, যদিও মানবাধিকার লঙ্ঘনে সেই বাহিনীর তুলনা তারাই। চীনও তাদের নিয়ন্ত্রণে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয় প্রায় একই কারণে। তা ছাড়া মিয়ানমার চীনের প্রতি একধরনের আনুগত্য পোষণ করেই টিকে রয়েছে।
রোহিঙ্গা মুসলিমদের একেবারে কাছের প্রতিবেশী বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে এবং অবৈধভাবে মাঝেমধ্যে তারা এ দেশে এসে বসবাস করছে। এবারও প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশের কোনো বৃহৎ রাজনৈতিক দল রোহিঙ্গাদের প্রতি অমানবিক আচরণের তীব্র নিন্দা করেনি। কারণ অবশ্য স্পষ্ট। তাহলে সেই ভরসায় আরো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে পড়বে এবং সেই ভার বহনের ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
জাতিসংঘের ভূমিকা তেমন জোরালো নয়। কেননা জাতিসংঘের কাঠামোগত অসংগতি এ ক্ষেত্রে বিরাট প্রতিবন্ধকতা। যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্স বা ব্রিটেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো শক্তিশালী ব্যবস্থার প্রস্তাব উত্থাপন করলে চীন বা রাশিয়া যে ভেটো দেবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? এসব কারণে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘের পদক্ষেপ হয়েছে অত্যন্ত সাবধানী। তার পরও জাতিসংঘ মিয়ানমারে পাঠিয়েছিল অবসরপ্রাপ্ত এক সেক্রেটারি জেনারেলকে, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা কেমন ও কোন পর্যায়ের। তিনি কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাননি। তাহলে কিভাবে মিয়ানমারের ভাগ্যহত রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার সংরক্ষিত হতে পারে? এ প্রশ্নের কোনো সহজ ও সরল উত্তর নেই।
জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের জনগণ যদি সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিল ও সমাবেশ-মহাসমাবেশের মাধ্যমে নিজ নিজ রাষ্ট্রের নেতা, মানবাধিকারকর্মী, সংস্থা, সংসদ সদস্য, ব্যবহারবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রোহিঙ্গাদের সীমাহীন দুর্দশার কথা অবগত করাতে সক্ষম হন, তাহলে সমগ্র বিষয়টি কোনো একসময় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এজেন্ডাভুক্ত হয়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে। তখন জাতিসংঘের বৃহৎ শক্তিগুলোর যে ভেটো ক্ষমতা রয়েছে, তা এড়িয়ে শুধু মানবিক কারণে বিশ্বজনমত এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। অন্য বিকল্প কোনো পথ কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। বিশ্বজনমত সুসংহতভাবে গড়ে ওঠার আগ পর্যন্ত মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু রাষ্ট্র তাদের কর্মসংস্থান করে তাদের অমানবিক জীবনের অবসান ঘটাতে পারে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপক ডেসমন্ড টুটুর (উবংসড়হফ ঞঁঃঁ) বক্তব্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘অন্যায়কারীর ঔদ্ধত্যের সময় নিশ্চুপ থাকার অর্থ হলো অন্যায়পরায়ণ শাসকের পক্ষ সমর্থন’ [জবসধরহরহম ংরষবহঃ ধঃ ঃযব ঃরসব ড়ভ রহলঁংঃরপবং রং ঃড় নব ড়হ ঃযব ংরফব ড়ভ ঃযব ঃুৎধহঃ]। বাংলাদেশের নোবেল লরিয়েট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অন্য ১১ জন সহযোগীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের এই অমানবিক আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
রাখাইন রাজ্যে (যা আরাকান নামেও পরিচিত) রোহিঙ্গারা বসবাস করছে দীর্ঘদিন ধরে। শুধু ধর্মের জন্যই এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ব্যক্তিরা সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মিয়ানমার তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। স্বাধীনভাবে চলাফেরারও অধিকার নেই। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ১৯৮২ সালের ‘বার্মা নাগরিকত্ব আইনে’ বার্মার ১৩৫টি জাতিসত্তাকে নাগরিক হিসেবে স্বীকার করলেও রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। রোহিঙ্গা সমস্যার সূচনা হয় ১৭৮৪ সালে। তখন বার্মার রাজা ইধফধঢ়িধধি স্বাধীন আরাকান রাজ্য দখল করেন এবং অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এই বৌদ্ধ নৃপতি আরাকানের মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা করে, শুধু তারা মুসলিম এ জন্য।
ওই সময় অনেকেই ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত বঙ্গদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৯৩৭ সালে আরাকান বার্মার অন্তর্ভুক্ত হলেও সেই রাজ্যে রোহিঙ্গাদের কোনো স্থান হয়নি। বাংলাদেশেও তারা স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ লাভ করেনি। বাংলাদেশ মনে করে, তারা মিয়ানমারের অধিবাসী। মিয়ানমার বিশ্বাস করে, তারা বার্মিজ নয়। তারা মুসলিম। এই হতভাগ্য মানুষগুলো এভাবে কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা লাভে বঞ্চিত হয়ে, কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে অথৈ সাগরে। স্থিতিশীলতা নেই বলে তাদের বা তাদের সন্তানদের কোনো শিক্ষা নেই, নেই কোনো স্থায়ী কর্মসংস্থান, নেই স্থায়ী আবাসভূমি। তারা শরণার্থীও নয়, নয় সাময়িকভাবে আশ্রয়হীনও। মানবসভ্যতার এই পর্যায়ে তাদের দুর্দশা দূর করার কী কেউ থাকবে না? তাদের কথা শোনার অথবা স্থায়ী আশ্রয়দানের কি কেউ থাকবে না এই বিপুলা পৃথিবীতে? এই প্রশ্নগুলো সবার হূদয়কে আন্দোলিত করুক।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[সংকলিত]