Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

harun-nbs24ডা. হারুন আর রশিদ : খােলা বাজার২৪।। শনিবার, ১১ মার্চ ২০১৭: গত ৯ মার্চ ছিল বিশ্ব কিডনি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘কিডনি রোগ ও স্থূলতা : চাই সুস্থ জীবন ও সুস্থ কিডনি’। বর্তমানে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ওজনের মানুষ বা মুটিয়ে যাওয়া মানুষগুলো কিডনি রোগে ভুগছে বেশি। এ জন্য স্থূলতাকে কিডনি রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে এবারের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে কিডনি রোগের অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ হলেও দেহের অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা, ধূমপান ও অস্বাস্থ্যকর খাবার অনেকাংশে দায়ী।

২০১১ সালে জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে কিডনি রোগসহ সব অসংক্রামক ব্যাধির ওপর আলোচনা হয়। এরপর ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে অসংক্রামক ব্যাধি, বিশেষত কিডনি রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পৃথিবীতে এখন প্রায় বিলিয়ন মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে কিডনি রোগের প্রকোপ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে দুই কোটির মতো মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছে। এখন প্রতি সাতজনের একজনই কিডনি রোগী। এর প্রকোপ বৃদ্ধিতে সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ বাড়ছে। উদ্বেগ বাড়ছে ডায়ালিসিস ও কিডনি সংযোজন নিয়ে। বর্তমানে দেশে মাত্র ১২০ জন কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। কিডনি আক্রান্ত এই দুই কোটি মানুষকে ১২০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে কিভাবে চিকিৎসা প্রদান সম্ভব? এ ক্ষেত্রে সব কিডনি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হলে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে প্রতিদিন ৮৫০ জনেরও বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই এখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বৃদ্ধির উদ্যোগ জরুরি। পাশাপাশি ব্যবস্থাও থাকা প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কিডনি রোগের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের। অধিকসংখ্যক বিশেষজ্ঞ নার্স ও প্যারামেডিকস তৈরি করাও সময়ের দাবি।

বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি মানুষের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, অর্থাৎ তারা মোটা। এই মোটা মানুষদের ডায়াবেটিস ও রক্তচাপের হার বেশি। এই বাড়তি ওজন কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে একধরনের নেফ্রাইটিসে বেশি ভোগে তারা। এ ছাড়া মোটাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতাও বেশি এবং তাদের কিডনি ক্যান্সারও হতে পারে। পরিসংখ্যান বলছে, মোটা মানুষের কিডনি রোগ হওয়ার প্রবণতা সঠিক ওজনের ব্যক্তিদের চেয়ে ৮৩ শতাংশ বেশি।

উন্নত বিশ্বে কিডনি রোগীদের ১৪ শতাংশ পুরুষ ও ২৫ শতাংশ মহিলাদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, যারা সবাই মোটা। এটা থেকে রক্ষা পেতে ছোটবেলা থেকেই ওজন নিয়ন্ত্রণ করার অভ্যাস গড়া দরকার। অতিরিক্ত খাবার, ফাস্ট ফুডসহ সব ধরনের কোমল পানীয় পরিহার করা উচিত। শিশুকাল থেকেই কোমল পানীয়ের বদলে সাধারণ পানি পানের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ডিম, দুধ ও মাছের পাশাপাশি টাটকা সবজি ও ফলমূল খেতে হবে। বর্জন করতে হবে তৈলযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত চিনি ও লবণ। প্রতিদিন সবাইকে হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলে খেলাধুলার প্রতিও মনোযোগী হতে হবে। ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে সব বয়সীদের। অভ্যাস করতে হবে সময়মতো ঘুমানোর। যাদের বসে বসে কাজ করতে হয়, তাদের অবশ্যই প্রাত্যহিক হাঁটার অভ্যাস করা উচিত। কেননা শরীর একবার মুটিয়ে গেলে তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা কষ্টকর। মুটিয়ে যাওয়ার আগেই পরিবারের সবার ওজন নিয়ন্ত্রণে মনোযোগী হতে হবে। স্বাভাবিক ওজনের মাধ্যমে সুস্থ জীবন ও সুস্থ কিডনি সম্ভব।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কিডনি রোগ হয়ে যাওয়ার আগে প্রতিরোধের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। এ ক্ষেত্রে দেশের প্রায় ১৫ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই ক্লিনিকগুলোতে গড়ে ছয় হাজারের মতো লোক প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়। এসব কেন্দ্রে রোগী আসার পরই তাদের প্রত্যেকের ওজন নির্ধারণ, রক্তচাপ পরীক্ষা, প্রস্রাব পরীক্ষা করে অ্যালবুমিন ও সুগার যাচ্ছে কি না তা যাচাইসহ রক্তের সুগার পরিমাপ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে যাদের রক্তচাপ ১৪০/৯০-এর ওপরে থাকবে, যাদের প্রস্রাবে অ্যালবুমিন ও সুগার শনাক্ত হবে, যাদের রক্তের সুগার ১১.১-এর ওপরে থাকবে, তাদের এসব তথ্য কম্পিউটারে অথবা খাতায় লিপিবদ্ধ করে রেকর্ড রাখতে হবে। এরপর যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস ধরা পড়বে ও যাদের প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নির্গত হচ্ছে তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অথবা জেলা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে হবে। রক্তের ক্রিয়েটিনিন অর্থাৎ কিডনির কার্যকারিতা ও ব্লাড সুগার পরীক্ষা করে কিডনি রোগ রয়েছে কি না তা যাচাই করে ওসব হাসপাতাল চিকিৎসা দেবে। এ ব্যবস্থা করা গেলে তৃণমূল পর্যায়ে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপসহ কিডনি রোগী শনাক্ত হবে। দুঃখজনক বিষয় হলো, এখানো ৫০-৬০ শতাংশ মানুষ জানেই না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ অথবা ডায়াবেটিস রয়েছে। আবার যাদের ধরা পড়েছে তাদের ৬০-৭০ শতাংশের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ওই ধরনের রোগীরাই ক্রমান্বয়ে কিডনি রোগীতে পরিণত হয়।

তাই এবারের বিশ্ব কিডনি দিবসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সব চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতালগুলোর প্রতি অনুরোধ, আসুন, কিডনি রোগ প্রতিরোধে আমরা সবাই এগিয়ে আসি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি অনুরোধ, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপসহ সব অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধের উপায়গুলো সহজ ভাষায় স্কুল-কলেজের শিক্ষা বা পাঠ্যপুস্তকে দ্রুত অন্তর্ভুক্ত করুন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কিডনি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, rashid@bol-online.com

অনুলিখন : আতাউর রহমান কাবুল [সংকলিত]