ড. সা’দত হুসাইন ।। খােলা বাজার২৪।। সোমবার, ১৭ এপ্রিল ২০১৭: নির্বাচন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। অনেকেই বলে, এটি হচ্ছে প্রধান স্তম্ভ। গণতান্ত্রিক দর্শনের মূল আকর্ষণ হচ্ছে, এ ব্যবস্থায় জনগণ তাদের পছন্দ অনুসারে শাসকগোষ্ঠী বেছে নিতে পারে। এক অর্থে জনগণের পছন্দ বা সমর্থনের জোরে শাসকদল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। জনগণের পছন্দ ক্ষমতার উৎস। কারণ গণতন্ত্রে জনগণই হচ্ছে সব ক্ষমতার মালিক। জনতার পছন্দ পরিমাপ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে নির্বাচন। ভিন্নরূপ শাসনব্যবস্থায় জনগণের পছন্দ-অপছন্দের দাম নেই। যেমন—রাজতন্ত্রে রাজা-রানি, সমাজতন্ত্রে পার্টির নেতা-নেত্রী, সামরিক শাসনামলে সেনাধ্যক্ষ, বিদেশি দখলদারদের শাসনকালে দখলদারদের নেতারা নিজেদের ইচ্ছামতো দেশ শাসন করেন। এরূপ কর্তৃত্ববাদী সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ থাকে না। সরকারের সিদ্ধান্ত জনস্বার্থের পক্ষে গেল কী বিপক্ষে গেল তা নিয়ে সরকার মাথা ঘামায় না। অগণতান্ত্রিক সরকার তথা শাসকগোষ্ঠীর কাছে তাদের নিজের স্বার্থ সবার ঊর্ধ্বে। যে সিদ্ধান্ত তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং সংবর্ধন করবে, সে সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করবে। দেশের মানুষের স্বার্থ কর্তৃত্ববাদী অগণতান্ত্রিক সরকার খুব একটা আমলে নেয় না।
যেহেতু গণতান্ত্রিক সরকার দেশের মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত হয়, সেহেতু এ সরকারের গঠন প্রক্রিয়ায় যাতে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা যথার্থরূপে প্রতিফলিত হয়, নির্বাচনপদ্ধতির মাধ্যমে তা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত করতে হবে। যদি পদ্ধতিগত কোনো ত্রুটির কারণে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন ব্যাহত হয় অথবা একটি বড় জনগোষ্ঠীর পছন্দ-অপছন্দ সম্পূর্ণরূপে অবদমিত হয়, তবে সে নির্বাচনপদ্ধতির কার্যকারিতা ও যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে। যদি দেখা যায় যে পদ্ধতির মধ্যে অযৌক্তিকতার আঁশ ভালোভাবে জট পাকিয়েছে, তবে সে পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হবে না। এরূপ পদ্ধতি পরিত্যাগ করে যৌক্তিক পদ্ধতি প্রচলন করা সমীচীন হবে।
নানা কারণে অযৌক্তিক ও ত্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির পরিবর্তে যৌক্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। অযৌক্তিক পদ্ধতি আমরা বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ অনুসরণ করে চলি।
আমরা প্রায় অন্ধভাবে পশ্চিমা ধাঁচের গতানুগতিক গণতান্ত্রিক ধারা নিজের দেশের জন্য গ্রহণ করেছি। এখানে মোটাদাগে গণতন্ত্রের দুটি মডেল আমাদের দৃষ্টিতে এসেছিল। একটি ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র, অন্যটি যুক্তরাষ্ট্র অথবা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির গণতন্ত্র। পার্লামেন্টারি ও প্রেসিডেন্ট-পদ্ধতির দোলাচলে প্রায় ২০ বছর কাটিয়ে অবশেষে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের জন্য আমরা পার্লামেন্টারি-পদ্ধতি বেছে নিয়েছি। সে পদ্ধতিতে আমরা এখনো আছি। মনে হয়, দীর্ঘ সময় আমরা এ পদ্ধতির মধ্যে থাকব। আপাতত পদ্ধতি পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
যখন যে পদ্ধতি আমরা গ্রহণ করেছি, অনেকটা অন্ধবিশ্বাস নিয়ে আমরা তা করেছি। অনুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পদ্ধতির উপযোগিতা, তার ভুলত্রুটি পর্যালোচনা করে দেখেনি। ফলে পদ্ধতির সংস্কার বা মেরামত করে এগুলো আরো উন্নত ও ত্রুটিমুক্ত করা হয়নি। ওয়েস্টমিনস্টার (ব্রিটিশ) পার্লামেন্টারি পদ্ধতি এবং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট-পদ্ধতি পরোক্ষ নির্বাচনের ভিত্তিতে রচিত। এই দুই পদ্ধতিতে বেশির ভাগ ভোটারের সমর্থন (Popular Vote) পাওয়া সত্ত্বেও একটি দল পরাজিত ঘোষিত হতে পারে। অপরপক্ষে সংখ্যালঘু বা কমসংখ্যক ভোটারের সমর্থন পাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী দল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে, নিতান্তই ফর্মুলার বদৌলতে। আমেরিকান নির্বাচনে বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্টের ক্ষেত্রে এরূপ ঘটেছে, বাংলাদেশের নির্বাচনেও তা ঘটেছে। গাণিতিকভাবে অযৌক্তিক বা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার কারণে এ ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে চলতে পারে না। আজ হোক, কাল হোক, পঞ্চাশ বছর পরে হোক—এ পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। অযৌক্তিক পদ্ধতির অবসান হবে। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে সরাসরি ভোটগ্রহণ ও গণনা মোটেই দুঃসাধ্য কাজ নয়। প্রত্যক্ষ ভোটের দিকে আমাদের যেতেই হবে।
পার্লামেন্টারি শাসনপদ্ধতিতে পরোক্ষ নির্বাচনের সহজ বিকল্প হচ্ছে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচনের (Proportional Representation) ব্যবস্থা করা। এ পদ্ধতিতে দেশব্যাপী প্রাপ্ত ভোটের সমানুপাতে একটি দল সংসদ সদস্যের হিসসাদার হবে। যারা সারা দেশের হিসাব মতে ন্যূনতম ভোট পাবে না, তারা আনুপাতিক হারে সংসদ সদস্যের ভাগীদার হবে না। এ পদ্ধতিতে যে দল বা জোট ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায়, তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা জোট থেকে বেশি ভোট পেতে হবে। ইউরোপের অনেক দেশে, এমনকি বাংলাদেশের আশপাশের দেশেও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা রয়েছে। আংশিকভাবে হলে আনুপাতিক হারের (Proportional Representation) প্রচলন এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নির্বাচনে জয়ী প্রার্থী নির্ধারণের প্রক্রিয়া এবং উচ্চ ফলধারী (Performance) প্রার্থীদের মূল্যায়নের ব্যাপারে সুতীক্ষ পর্যালোচনা হয়নি। বর্তমানে First Past the Post-পদ্ধতিতে জয়ী প্রার্থী নির্ধারণ করে নির্বাচনোত্তর সব সুবিধা শুধু তাঁকেই দেওয়া হয়। এর অর্থ হচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সবার চেয়ে বেশিসংখ্যক ভোট পেয়েছেন, শুধু তাঁকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তিনি কত শতাংশ ভোট পেয়েছেন, এ পদ্ধতিতে তা দেখার অবকাশ নেই। ধরুন, তিনি প্রদত্ত ভোটের ৩৮% ভোট পেয়েছেন, তাহলে ৬২% ভোটার তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। সুতরাং তিনি বেশির ভাগ ভোটারের পছন্দের প্রার্থী নন। মোট ভোটারের একটি সংখ্যালঘু অংশ তাঁকে পছন্দ করেছেন। এ নিয়েই তিনি নির্বাচিত ব্যক্তি হিসেবে সংসদ সদস্য অথবা স্থানীয় সরকারের নির্বাহী হিসেবে ঘোষিত হবেন এবং ওই পদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী যদি মাত্র তিন ভোটের ব্যবধানে হেরে যান, তবে তিনি পরাজিত প্রার্থী হিসেবে ঘোষিত হবেন এবং নির্বাচন-উত্তরকালে সংশ্লিষ্ট পদের সঙ্গে সংযুক্ত কোনো সুবিধা বা মর্যাদার অংশীদার হবেন না। এলাকার বিপুলসংখ্যক লোকের পছন্দের ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তিনি শূন্য-গুরুত্ব ব্যক্তিত্বে পর্যবসিত হবেন। প্রেসিডেন্ট-পদ্ধতির নির্বাচনে এ কথাটি বেশি সত্য। নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ব্যক্তি বাস্তবিকপক্ষে গুরুত্বহীন শূন্যতে পরিণত হন। পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে অবশ্য পরাজিত দল দ্বিতীয় স্থানে থাকলে এবং তার নেতা নিজ নির্বাচনী এলাকায় বিজয়ী হলে তিনি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান। ফলে তিনি ওই পদের উচ্চ মর্যাদা এবং এতদসংশ্লিষ্ট নানাবিধ সুয়োগ-সুবিধা ভোগ করেন। এদিক থেকে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র রাষ্ট্রপতিপদ্ধতির গণতন্ত্রের চেয়ে শ্রেয়, তাতে সন্দেহ নেই।
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একজনকে জয়ী ঘোষণা করে বাকি সবাইকে শূন্যের খাতায় মিশিয়ে দেওয়া গাণিতিক যুক্তিতে কিছুটা হলেও ত্রুটিপূর্ণ। সেই বিতরণ শ্রেষ্ঠ, যা একটি অবিচ্ছেদ্য ধারাবাহিকতায় (Continuum) বিস্তৃত হয়। অর্থাৎ প্রতি অংশগ্রহণকারীর সামান্য অবদান যেন ন্যায়ানুগভাবে স্বীকৃতি পায়। অবদান অতীব নগণ্য হলে তাকে গুরুত্বহীন বা Insignificant হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। সেই Insignificant অবদানকে বাদ দিয়ে, বাকি অংশগ্রহণকারীদের যদি তাঁদের অবদানের অনুপাতে স্বীকৃতি দেওয়া যায়, পুরস্কৃত করা যায়, তবে সে বিতরণ হয় সবচেয়ে যৌক্তিক ও ন্যায়ানুগ। অর্থনীতিতে এ ধরনের বিতরণ ও লেনদেনের সম্পর্ককে বলা হয় পরিপূর্ণ বিভাজনতা (Perfect Divisibility)। এর ফলে প্রতিজন ‘এজেন্ট’ তাঁর অবদানের অনুপাতে প্রতিদান পান। Insignificant দু-একজন ছাড়া কারো অবদানকে অবজ্ঞা করা হয় না।
যদি দেখা যায় যে জয়ী প্রার্থী ছাড়া আরো দু-একজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিপুল সমর্থন রয়েছে, যে কারণে জয়ী প্রার্থীর সঙ্গে তাঁদের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান নগণ্য, তবে সেই দু-একজন পরাজিত প্রার্থীকে যেকোনো উপায়ে স্বীকৃতি দেওয়া যৌক্তিক হবে। কিভাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদের নির্বাচন-উত্তর প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা, আলোচনা-পর্যালোচনা করা যেতে পারে। একটি সম্মত পথ বের করতে সময় লাগবে। এ পর্যায়ে সমস্যাটি স্বীকার করে নিয়ে আলাপ-আলোচনা, পর্যালোচনা শুরু করাই বড় কাজ।
পুরো মেয়াদকাল ভাগ করে একাধিক ব্যক্তির ক্ষমতা ভাগাভাগি করে সংগঠন পরিচালনার উদাহরণ বাংলাদেশে রয়েছে। উল্লেখযোগ্য জনসমর্থন রয়েছে—এমন পরাজিত প্রার্থীকে নির্বাচনোত্তর প্রশাসনে অন্তর্ভুক্ত করার উদাহরণ আফগানিস্তান ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে রয়েছে। কম্বোডিয়ায় দুজন প্রধানমন্ত্রী একসঙ্গে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে দেশ পরিচালনা করেছেন। তাতে সহিংসতা ও অস্থিরতার আশঙ্কা কমেছে। এরূপ উদ্ভাবনীমূলক চিন্তা ও কৌশলের মাধ্যমে আমরা নতুন পথের সন্ধান পেতে পারি। পশ্চিমা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্ভুল ও কালোত্তীর্ণ ধরে নিয়ে তাদের প্রদর্শিত পথে বিনা বাক্য ব্যয়ে হাঁটলে আমরা অনেক সমস্যার কোনো সমাধান পাব না। যে তিমিরে ছিলাম, সে তিমিরে থেকে যাব।
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান