মোস্তফা কামাল । খােলা বাজার২৪।। মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭: রফিক উদ্দিন ও জামিল আহমেদ (কাল্পনিক নাম) দুই বন্ধু। তাঁদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আরেকজন সাংবাদিক। তাঁরা দুজন ফেসবুক সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলছিলেন। তাঁদের কথাবার্তা রঙ্গব্যঙ্গ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
রফিক উদ্দিন : প্রযুক্তি নাকি প্রকৃতির আশীর্বাদ। মানুষের জীবনকে সহজ থেকে সহজতর করছে এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। ছোটবেলায় আমরা আমাদের গ্রামে দেখেছি, তখন থানা পর্যায়েও কোনো টেলিফোনব্যবস্থা ছিল না। জরুরি বার্তা পৌঁছানোর জন্য টেলিগ্রাম করা হতো। দিনে দিনে টেলিফোনব্যবস্থার আধুনিকায়ন হয়েছে। নানা পর্যায় পার করে নব্বইয়ের দশকে এসেছে মোবাইল ফোন। সেই মোবাইলের কী ডাঁট!
জামিল আহমেদ : ঠিক বলেছিস। তখন তো মোবাইল ব্যবহার করা ছিল একটা প্রেস্টিজ। কারো হাতে মোবাইল দেখলে আমরা কী কৌতূহল নিয়ে তাকাতাম! কয়েক বছরের মধ্যেই মোবাইল ফোন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে চলে এলো। এখন তো রিকশাওয়ালা, দিনমজুরদের হাতেও মোবাইল! সবাই বলে, এখন নাকি ‘ফেসবুক যুগ’ চলছে।
রফিক উদ্দিন : ঠিকই তো! ফেসবুক সংস্কৃতি মানুষকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে যে এর থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। কর্মহীন মানুষও সারাক্ষণ ব্যস্ত ফেসবুক নিয়ে। কিশোর থেকে বয়োবৃদ্ধ—সবাই ফেসবুক ভাইরাসে আক্রান্ত। সকাল-দুপুর, বিকেল, রাত, মধ্যরাত—সর্বক্ষণ ফেসবুকে বুঁদ হয়ে থাকে ব্যবহারকারীরা। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া নষ্ট। অনেকেই এর অপব্যবহার করছে। নামে-বেনামে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণা করছে। মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। ব্যক্তিজীবনকে করে তুলছেন দুর্বিষহ।
জামিল আহমেদ : তবে এর অনেক ভালো দিকও আছে বন্ধু! অনেকে পুরনো বন্ধুকে খুঁজে পাচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে। বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনের বড় জায়গা হয়ে গেছে ফেসবুক। আবার অনেকে লেখালেখির জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে ফেসবুক। ছড়া, কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনিই শুধু নয়, মত প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠেছে ফেসবুক। আবার এই ফেসবুকই কিন্তু আরব বসন্ত সৃষ্টি করেছিল। একসময় যাঁরা বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করতে রাস্তায় নামতেন, তাঁরা এখন ঘরে বসে ফেসবুকের মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলেন। কোনো অর্থ খরচ হয় না। লোকজন জোগাড় করার ঝামেলা পোহাতে হয় না।
রফিক উদ্দিন : এটাই তো ভালো, ভালো না! তুই দেখিস না, রাস্তায় মিছিল বের হলে কী অবস্থা হয়! ঢাকা শহর মুহূর্তের মধ্যে অচল হয়ে যায়। তার চেয়ে ঘরে বসে ফেসবুকে আন্দোলন করা ভালো না?
জামিল আহমেদ : হু, ভালোই তো। কিন্তু সমস্যা কী জানিস?
রফিক উদ্দিন : কী সমস্যা?
জামিল আহমেদ : এর মধ্যে অনেক দুষ্টলোক ঢুকে গেছে। তারা এটিকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করছে। একটা ঘটনার কথা তোকে বলি। একবার জয়া আহসানের নামে ফেসবুক আইডি খুলে জনৈক ব্যক্তি সাংবাদিকদের প্রতারণা করে আসছিল। অখ্যাত নাট্যকার, নাট্যকর্মী ও মডেলদের (নারী-পুরুষ) নিউজ কাভারেজ দেওয়ার অনুরোধ করে। দিন দিন সেই অনুরোধের মাত্রা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে বিনোদন সাংবাদিকরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, সেটি জয়া আহসানের আসল আইডি নয়।
রফিক উদ্দিন : ওই প্রতারককে কিছু বলিসনি?
জামিল আহমেদ : ফেক আইডি। কাকে কী বলব; আর কাকে ধরব?
রফিক উদ্দিন : আরেকবার আমার এক বন্ধুর একটা স্ট্যাটাস দেখলাম। সেখানে তিনি লিখেছেন, গ্রামের স্কুল-কলেজের মেয়েরা সাবধান! তারপর তিনি লিখেছেন, কিছু প্রতারক গ্রামের স্কুল-কলেজের মেয়েদের সঙ্গে ফেসবুকে ছলেবলে-কৌশলে বন্ধুত্ব করে। তাদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে। তারপর ফুসলিয়ে তাদের ঢাকায় নিয়ে আসে। এরপর গ্রামের সহজ-সরল মেয়েরা সম্ভ্রম হারায়। একসময় এদেরই প্রচুর টাকার বিনিময়ে বিদেশে পাচার করা হয়।
জামিল আহমেদ : ঠিক বলেছিস বন্ধু। নানাভাবে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে। আমি এর মধ্যেই একটা প্রতিবেদন দেখলাম। ঘটনাটা ভারতের। এক সুন্দরী নারী ক্যান্সারে আক্রান্ত বলে ফেসবুকে সাহায্যের আবেদন করেন। সুন্দরী বান্ধবীকে বাঁচানোর জন্য বন্ধুরা সাহায্যের হাত বাড়ান। সেই সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়াল প্রায় ৭০ লাখ টাকা। শেষ পর্যন্ত জানা গেল, সেই নারী ক্যান্সার আক্রান্ত ছিলেন না। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্যই তিনি এই অপকৌশলের পথ বেছে নিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ধরা পড়েছেন তিনি।
রফিক উদ্দিন : ভাগ্যিস, ধরা পড়েছে! আমাদের দেশের কিছু সুন্দরী মেয়ে আছে। এরা বিত্তবান ছেলেদের টার্গেট করে। তারপর প্রেমের ফাঁদ পাতে। নানা প্রলোভন দেখিয়ে কাছে টানার চেষ্টা করে। এ প্রক্রিয়ায় তারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এ রকম হাজারো উদাহরণ আছে।
জামিল আহমেদ : হ্যাঁ, তা তো আছেই! আমার মনে হয় কী জানিস?
রফিক উদ্দিন : কী মনে হয়?
জামিল আহমেদ : এটিকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনা উচিত। এ ক্ষেত্রে ফেক আইডি বন্ধ করা জরুরি। শুধু তা-ই নয়, ফেসবুক আইডি খোলার জন্য ‘ভোটার আইডি’ (কোনো কোনো দেশে ‘সিটিজেন আইডি’) নম্বর সংযুক্ত করা যায়। তাহলে প্রতারক চিহ্নিত করা সহজ হবে। কেউ প্রতারণা করলে সে ধরা পড়ে যাবে।
রফিক উদ্দিন : ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারে। নিশ্চয়ই অপব্যবহার রোধ করার ব্যবস্থা আছে! এটা করা না গেলে মানুষের বিপদের নাম হবে ফেসবুক!
জামিল আহমেদ : ঠিক বলেছিস। আমি নিজেও আতঙ্কে আছি।
রফিক উদ্দিন : কেন?
জামিল আহমেদ : আমার মেয়ে ফেসবুকে আইডি খুলেছে। সে কার না কার পাল্লায় পড়ে!
রফিক উদ্দিন : ভাবিকে নজর রাখতে বলিস। তা না হলে সত্যিই বিপদ!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক