খােলা বাজার২৪।। সোমবার, ২২ মে, ২০১৭: এ এম এম শওকত আলী
রাষ্ট্রীয় তিনটি অঙ্গের কার কত ক্ষমতা তা নিয়ে অতীতেও বিতর্ক হয়েছে। এ ধরনের বিতর্কে মূলত নির্বাহী ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই এ ধরনের বিতর্ক হয়। তবে সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশেই এ বিতর্ক একটু বেশি হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করে। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করা এখনো সম্ভব হয়নি মর্মে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি। ২০১৬ সালে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের সঙ্গে আইনমন্ত্রী দ্বিমত প্রকাশ করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এক ডজন জেলা পর্যায়ের জজের বেতন নির্ধারণসংক্রান্ত মামলায় ২০০০ সালের আগে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ ৯ বছর পরে পৃথক্করণের রায় বাস্তবায়িত হয়। এর আওতায় আগে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনস্থ নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচার ক্ষমতা রদ করা হয়। এসব ম্যাজিস্ট্রেটের বদলে বিচার বিভাগে নিযুক্ত অধস্তন আদালতের বিচারকরা ম্যাজিস্ট্রেটের যাবতীয় বিচারকার্য পরিচালনার কাজ শুরু করেন। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ওই সময় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনাও ছিল। যেমন—এক. জেলা পর্যায়ের বিচারকদের নিয়ে একটি পৃথক জুডিশিয়াল সার্ভিস হবে, যা সুপ্রিম কোর্টের অধীনস্থ থাকবে। দুই. তাঁদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও শৃঙ্খলাবিষয়ক সিদ্ধান্তও সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারভুক্ত। তিন. এর জন্য পৃথক জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন ও পৃথক জুডিশিয়াল ট্রেনিং একাডেমিও স্থাপন করতে হবে। তাঁদের বেতনক্রমও নির্বাহী বিভাগের ক্যাডারভুক্ত হবে না। বিচার বিভাগীয় সার্ভিসে প্রাথমিক নিয়োগ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সুপারিশেই রাষ্ট্রপতি সম্মতি প্রদান করেন। কিন্তু এর মধ্যবর্তী অবস্থানে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও রয়েছে। প্রাথমিক নিয়োগের নথি সুপ্রিম কোর্ট থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার জন্য এ মন্ত্রণালয়ই সরকারি কার্যবিধিমালা (Rules of Business) অনুযায়ী ক্ষমতাবান। বদলি ও শৃঙ্খলার বিষয়ে একই পদ্ধতি এখনো অনুসরণ করা হচ্ছে। এর ভিত্তি হলো ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে মূলধারার পরিবর্তে অন্য দুটি ধারার সংশোধনীর আদেশ।
১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানের ব্যাপকভাবে সংশোধন করে ১৯৭৫ সালের ২ নং আইন প্রণয়ন করে। এর ফলে দেশে বাকশাল নামে একদলীয় শাসন প্রথা প্রবর্তন করা হয়। তখনকার সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিষয়ে অনেক কিছু পরিবর্তন করা হয়। বর্তমান বিতর্কের অন্যতম উৎস এখানেই। বাকশাল আইনের ১৮ নং ধারায় বলা ছিল, ‘সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন : সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদের পরিবর্তে নিম্নরূপ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপিত হইবে। ’ ‘১১৫ : অধস্তন আদালতে নিয়োগ বিচার বিভাগীয় দায়িত্বপালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উক্ত উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিসমূহ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করিবেন। ’ উল্লেখ্য, উপরোক্ত ১৯ ধারাবলে ‘সুপ্রিম কোর্টের’ পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত। একই আইনে ১৯৭৮ সালে সামরিক শাসনামলের সময় সংবিধান সংশোধন করা হয়। সংশোধিত ১১৫ অনুচ্ছেদ ও সংশোধিত ১১৬ অনুচ্ছেদ হলো “বিচার কর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্বপালনের ও ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি প্রদান, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলা বিধান ‘রাষ্ট্রপতি’র ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে। ” এর পাদটীকায় জানা যায় যে আগের অর্থাৎ ১৯৭২ সংবিধানে ‘সুপ্রিম কোর্ট’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হয়। প্রধান বিচারপতি এসব অনুচ্ছেদের পরিবর্তে ১৯৭২ সালের মূল অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করতে ইচ্ছুক। তাঁর ধারণা, এটা না করা হলে অপেক্ষমাণ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে না। বিদ্যমান প্রথাকে তিনি বিচার বিভাগের জন্য ‘দ্বৈত শাসন’ বলে অভিহিত করেছেন। অসংশোধিত ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনর্বহালের দাবি প্রথমে রাজনৈতিক দাবি ছিল। বর্তমানে এ দাবি বিচার বিভাগের বা প্রধান বিচারপতির। তবে এ দুই মহলের দাবির মধ্যে পার্থক্য এই যে প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ সম্পর্কিত একটি ধারার বদলে ১৯৭২ সালের ধারা প্রতিস্থাপনের কথা বলছেন যেখানে ‘রাষ্ট্রপতি’ শব্দটির বদলে ‘প্রধান বিচারপতি’ শব্দটি ছিল। আইনমন্ত্রী বলেছেন যে এ ধারা হাইকোর্টের রায় বলে বিলুপ্ত বলে গণ্য।
হাইকোর্টের কোন সালের রায়ে কথিত অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়েছিল তা অবশ্য জানা যায়নি। সাধারণভাবে যা জানা আছে, ২০০৯ সালের পর উচ্চ আদালতের এক মামলার রায়ে সামরিক শাসনামলের সব সংবিধান সংশোধনী আদেশ বাতিল করা হয়। এ ক্ষেত্রেই কিছু অস্পষ্টতা বা সঠিক তথ্যের বিষয়ে অনেকেরই জানা নেই। কারণ ১৫তম সংবিধান সংশোধনী আদেশটি সামরিক শাসনের সময় ২ নং ফরমান বলে জারি করা হয়। ২ নং আইনে সংশোধনীর মধ্যে ছিল ‘কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিসহ ছুটি মঞ্জুরি ও শৃঙ্খলাবিধান) [রাষ্ট্রপতির] ওপর ন্যস্ত থাকিবে। ’ সামরিক ফরমান বলে যা সংযোজন করা হয় তা হলো ‘এবং সুপ্রিম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তাহা প্রযুক্ত হইবে। ’ অর্থাৎ হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত রায়ে সামরিক শাসনামলের সব সংশোধনী আদেশ যদি বাতিল বলে গণ্য হবে, তাহলে শেষোক্ত সংশোধনী কার্যকর থাকার কথা নয়। এসব অস্পষ্টতা সম্পর্কে আরো বলা যায় যে ১৯৭৫ সালের ২ নং আইনে অর্থাৎ বাকশাল আমলে সংবিধানে ১১৬ক অনুচ্ছেদ সংযোজিত হয়। এ অনুচ্ছেদ হলো [১১৬ক। এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচার কার্যপালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন]। এ সংশোধনীকে অলংকারতুল্য সংশোধন বলা যায়। কারণ যেখানে নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির এবং যা প্রকৃতপক্ষে আইন মন্ত্রণালয় করে থাকে, তার মাধ্যমে স্বাধীনভাবে বিচার করা খুবই কঠিন। ওই সময় অবশ্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয়নি। এ কারণেও এ ধরনের সংশোধন অনেকটা সান্ত্বনা দেওয়ার মতো। বাকশাল কাঠামো সামরিক শাসনামলেই বাতিল করা হয়। কিন্তু সংবিধানের সংশোধনীর ক্ষেত্রে কী করা হয়েছে তা অনেকাংশে অস্পষ্ট।
বর্তমান বিতর্কের মূল কারণ অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলাবিষয়ক ক্ষমতা নিয়ে। সংবিধানের ১১৫ ধারা ১৯৭২ সংবিধানের মূল ধারা দিয়ে প্রতিস্থাপন না করলে এ বিতর্কের অবসান হবে না। এ বিষয়ে যথেষ্ট অগ্রগতির কথাও আমরা পত্রিকান্তরে দেখেছি। সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদিত এসংক্রান্ত বিধি গেজেটে প্রকাশ করা হবে—এ কথা বারবার শোনা গেলেও তা করা হয়নি। প্রকাশ করার দায়িত্ব আইন মন্ত্রণালয়ের। কী কারণে এ মন্ত্রণালয় অনুমোদিত বিধি গেজেটে প্রকাশ করছে না, তা অবশ্য জানা যায়নি। বর্তমান সালের বিতর্ক এখন কিছুটা স্তিমিত হলেও সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। এ সমস্যার সমাধান না হলে এ বিতর্ক সময় সময় হবে বলেই ধারণা করা যায়। পক্ষান্তরে এ কথাও বলা যায় যে ১৯৯৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তার প্রায় সবই কার্যকর করা হয়েছে। যে অপূর্ণতা রয়ে গেছে তা হলো নিয়োগ, বদলি ও শৃঙ্খলাবিষয়ক ক্ষেত্রগুলোতে বিচার বিভাগের কার্যকর ক্ষমতা। এ দৃষ্টিকোণে বিচার করলে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে বলে মনে হয়। এখন আর ১৯৭২ সালের মূলধারা প্রতিস্থাপন করা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা হলো সংশ্লিষ্ট বিধি গেজেটে প্রকাশ করা। এ বিষয় নিয়েও গত ৯ মে একটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এ সংবাদে জানা গেছে যে রাষ্ট্রপক্ষ আবার গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য দুই সপ্তাহের সময় প্রার্থনা করেছে। আরো জানা যায় যে বারবার সময়ের আবেদনের কারণে প্রায় আড়াই বছর সময় পেরিয়ে গেছে। এ সত্ত্বেও গেজেটে সংশ্লিষ্ট বিধি প্রকাশ করা যায়নি।
রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের কার ক্ষমতা কত তা সংবিধানেই ১৯৭২ সালে বলা হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে কিছু সংশোধনীর ফলে বিচার ও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়েছে। সর্বশেষ সংবাদে জানা যায় যে সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপক্ষের প্রার্থনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিধি প্রকাশের জন্য আরো দুই সপ্তাহের সময় দিয়েছেন। এর পরও সময়ের প্রয়োজন হবে কি না তা ভবিষ্যতেই জানা যাবে।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা