খােলা বাজার২৪।। মঙ্গলবার, ৩০ মে, ২০১৭: মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)
১৯৬২ সালের অক্টোবর মাস। চীনের বিপ্লবী নেতা মাও জে দং তাঁর রাজনৈতিক ও সামরিক কমান্ডারদের পেইচিংয়ে ডেকে আনেন। পেইচিং থেকে দুই হাজার মাইল পশ্চিমে হালকা জনবসতিসম্পন্ন এলাকা হিমালয়ের পাদদেশে অমীমাংসিত সীমানার নো ম্যানস ল্যান্ডে চীন-ভারতের সেনাদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজমান। ভারত দাবি করে ব্রিটিশ কর্তৃক নির্ধারিত সীমানা, আর চীনের দাবি, তাদের ইমপেরিয়াল (ডাইনেস্টি শাসন) যুগের সীমানা। ভারতীয় সেনারা নো ম্যানস ল্যান্ডের ভেতরে এসে কয়েকটি সেনাপোস্ট তৈরি করে বসে আছে, যা চীনের স্থানীয় সেনা কমান্ডাররা মেনে নিতে পারছেন না। স্থানীয় পর্যায়ের চেষ্টায় সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। মাও জে দং চান চটজলদি নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে ভারতীয় সেনাপোস্ট হটিয়ে ভারতকে আলোচনার টেবিলে এনে দুই দেশের মধ্যে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হোক। মাও তাঁর সেনা কমান্ডারদের মনে করিয়ে দেন, ঐতিহাসিক লিগ্যাসির কারণেই চীন-ভারত কখনোই চিরশত্রু হয়ে থাকতে পারে না। মাও সতর্কবাণী হিসেবে উল্লেখ করেন, সেনা কমান্ডাররা যেন বাড়াবাড়ি না করেন। মাও জে দংয়ের নির্দেশ অনুসারে চীনা সেনারা আকস্মিক আক্রমণে ভারতীয় সেনাদের অস্থায়ী পোস্ট থেকে আগের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর হটিয়ে দেয়। হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর নিজের লেখা ৬০০ পৃষ্ঠার ‘হেনরি কিসিঞ্জার অন চায়না’ গ্রন্থের একেবারে শুরুতে প্রোলগ লিখতে গিয়ে এভাবেই ওই ঘটনাটির বর্ণনা দিয়েছেন। ৬০০ পৃষ্ঠার বইয়ের পুরোটাতেই চীনের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিসিঞ্জার তাঁর নিবিড় অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে বইয়ের শুরুতেই চীন-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ওই ঘটনার অবতারণা করলেন কেন? এ প্রসঙ্গে কিসিঞ্জার অন্য লেখায় বলেছেন, একবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে বিশ্বের চালিকাশক্তির আসনে বসবে এশিয়া এবং তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে চীন-ভারত সম্পর্ক কোন দিকে গড়ায় সেটির ওপর। তিনি বলেছেন, চীন-ভারত যদি সহাবস্থান ও ইনক্লুসিভ দর্শনের হাত ধরে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে তবে তা একরকম হবে, আর এই দুই বৃহৎ রাষ্ট্র ও ভবিষ্যতের কর্ণধারদ্বয় যদি দূরে সরে গিয়ে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের দিকে যান, তাহলে সেটার পরিণতি অন্য রকম হবে।
গত ১৪-১৫ মে পেইচিংয়ে অনুষ্ঠিত বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের অনুপস্থিতি ও তাদের অবস্থান সবার চোখে পড়েছে। স্ট্র্যাটেজিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানের গোয়াদর নৌবন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে চীন কর্তৃক করিডর তৈরি করাকে ভারত মনে করছে, এটা তাদের সার্বভৌমত্বকে অবমাননার শামিল। কারণ কাশ্মীরের ওই অংশকে ভারত তাদের নিজের বলে দাবি করে আসছে। তা ছাড়া ভারতের কিছু বুদ্ধিজীবী ও থিংকট্যাংক মনে করছে চীনের এই মেগা প্রকল্পের উদ্দেশ্যই হলো ভারত মহাসাগরে চীনের নৌবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা ও প্রভাব নিশ্চিত করা, যা শেষ বিচারে ভারতের স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করবে। ভারতীয়দের কথার মধ্যে যুক্তি আছে এবং তাদের আশঙ্কাকেও ফেলে দেওয়া যায় না। চীন-ভারত দ্বন্দ্বের কারণ ও তার সূত্রপাত মূলত অমীমাংসিত সীমানা নিয়ে। যেখানে ১৯৬২ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতা ভারতের জন্য পীড়ার কারণ হয়ে আছে, সেটাও ঠিক। তবে একজন এশিয়াবাসী ও দুই দেশের মাঝখানে অবস্থিত বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমার প্রশ্ন, তারা কি অতীতের তিক্ততার মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রাখবে, নাকি সমগ্র অঞ্চলের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে তিক্ততা ভুলে বরং অতীতের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় সামনে এনে ভবিষ্যতের সোপান রচনা করবে? চীন ও ভারত উভয়েরই গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে। আধুনিক বিশ্বের সূত্রপাত ইউরোপের সায়েন্টিফিক রেভল্যুশনের বীজ রচিত হয় ভারতে। অঙ্কশাস্ত্রের জিরো (শূন্য) ও ভগ্ন সংখ্যা (ডেসিমাল নাম্বার) আবিষ্কৃত হয় ভারতের গুপ্ত শাসনামলে (চতুর্থ-ষষ্ঠ শতাব্দী), যা পরে আব্বাসীয় খেলাফতের স্বর্ণযুগে মুসলমান বিজ্ঞানীদের হাত হয়ে ইউরোপে যায়। অন্যদিকে আধুনিক যুগের আগ পর্যন্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানে ইউরোপ থেকে চীন অনেক এগিয়ে ছিল। কম্পাস, গানপাউডার, কাগজ ও প্রিন্টিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার সে যুগে চীনেই হয়। ইতালিয়ান নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস ও পর্তুগিজ নাবিক ভাসকো দা গামা পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে নতুন নতুন মনুষ্যভূমি আবিষ্কার ও সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকায় ইউরোপের উপনিবেশ স্থাপনের সূত্রপাত ঘটানোর প্রায় ৯০ বছর আগে পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুতে চায়নিজ নাবিক অ্যাডমিরাল ঝেং ইস্ট ইন্ডিজ আরব মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার পুরো উপকূল জাহাজে প্রদক্ষিণ করেন এবং সেসব অঞ্চলে চায়নিজ শাসন সম্প্রসারণের প্রস্তাব করেন সম্রাটের কাছে। কিন্তু তখন মিং ডাইনেস্টির সম্রাট সে প্রস্তাব নাকচ করেন এবং ১৪৩০ সালে অ্যাডমিরাল ঝেংকে সব অ্যাডভেঞ্চার বন্ধের হুকুম দেন। সে সময় অ্যাডমিরাল ঝেংয়ের প্রস্তাব সম্রাট গ্রহণ করলে বিশ্বের ইতিহাস অন্য রকম হতে পারত। পরে প্রায় ২০০ বছর সমগ্র ভারত উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকে। অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে চীনকেও কম নিগৃহীত হতে হয়নি। প্রথম অপিয়াম যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২) চীনের কাছ থেকে ব্রিটিশ বাহিনী হংকং দখল করে নেয়। তারপর দ্বিতীয় অপিয়াম যুদ্ধে (১৮৫৬-৬০) ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে চীন পরাজিত হয় এবং পেইচিংয়ের ঐতিহ্যবাহী ফরবিডেন সিটিও স্বল্পকালের জন্য পশ্চিমা সেনাবাহিনী দখল করে রাখে।
বিবর্তনের ধারায় প্রায় ২০০ বছর পর আবার এশিয়ান শক্তির উত্থান হতে যাচ্ছে, যার সম্মিলিত নেতৃত্ব দিতে পারে চীন ও ভারত। উদীয়মান এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে ঘিরে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক কৌশলের উদ্দেশ্য বোঝার মতো পরিপক্বতা চীন-ভারত উভয়েরই আছে। বোঝা যায়, তারা সেই পুরনো ডিভাইড অ্যান্ড রুল কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। একই কৌশলে তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ফেলতে পেরেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। চীন ও ভারত এটা বোঝে বলেই দেখা যায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের ভারত সফরের সময় দুই দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে ৪১টি সহযোগিতামূলক চুক্তি ও দলিল স্বাক্ষরিত হয়। আরো ৪১টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় দুই দেশের প্রদেশ ও মহানগরের মধ্যে। চীন পাঁচ বছরে ভারতে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করে। দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ এখন ৭১ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালের মধ্যে তা ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে উভয় দেশ। চীনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত নয়, যুক্তরাষ্ট্র। আলোচিত বিআরআইয়ের সঙ্গে ৬৮টি দেশ সংযুক্ত হচ্ছে; যাদের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ বিশ্বের মোট জিডিপির ৪০ শতাংশ। আলোচ্য প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার সক্ষমতা চীনের রয়েছে। বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু চ্যালেঞ্জে কম নয়। এ প্রকল্প সম্পর্কে পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও সন্দেহের মাত্রাও কম নয়। জার্মানি, ফ্রান্সসহ পশ্চিম ইউরোপ পেইচিং সম্মেলনে প্রতিনিধি পাঠালেও ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেনি। ভারত যোগদান করেনি। সত্যিকার অর্থে ভারত এ প্রকল্পের বিরোধিতা করলে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে BRICS, BCIM ও BIMSTEC-এর মতো অন্যান্য সহযোগিতামূলক কাঠামোর ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। তবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ও সংযোগ ভারতের জন্য কম গুরুত্বের নয়। তাই ভারতকে ভাবতে হবে তারা কি এত বিশাল সম্ভাবনাময় প্রকল্পের বাইরে থেকে সেটির সঙ্গে লড়াই করবে, নাকি এর ভেতরে ঢুকে নিজেদের শঙ্কা ও সন্দেহ মাথায় রেখে এর থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করবে? ভারসাম্যমূলক একটি অবস্থান বজায় রাখতে পারলে তাতে ভারতই বেশি লাভবান হবে। অন্যদিকে চীনকে মনে রাখতে হবে, ভারত বাইরে থাকলে চ্যালেঞ্জের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। ভারতের উদ্বেগের প্রতি চীনকে সম্মান দেখাতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের ন্যায্য আকাঙ্ক্ষাকে ঠেকিয়ে রাখা নয়, বরং চীনকে তার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। সেটাই হবে এশিয়ার সম্মিলিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ।
চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের মধ্যে চীনের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রয়েছে—এ কথা সবাই জানে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় অবস্থান থেকে ভারত, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে অব্যাহতভাবে জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত। এই প্রশ্নে চীনের অবস্থান আরো স্পষ্ট না হলে বিআরআইসহ অন্যান্য আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক কাঠামো অবশ্যই বাধাগ্রস্ত হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কী হওয়া উচিত তা নিয়ে অনেকেই ভাবছে। চীন-ভারতের মতপার্থক্য ও প্রতিযোগিতার জন্য ওই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কোনো হেরফের হবে না, বরং তা আরো উন্নত হবে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের একটা বিশেষ জায়গা রয়েছে, বিশেষ মাত্রা আছে, যা বজায় রাখা উভয় দেশের জন্য অপরিহার্য।
আজ ভারত-বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন একই সূত্রে গাঁথা। ভারতকে পাশে পাওয়া বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশকে পাশে পাওয়া ভারতের জন্য আরো বেশি প্রয়োজন। বাংলাদেশ যত সমৃদ্ধ হবে, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সক্ষমতা যত বৃদ্ধি পাবে, সেটি একই মাত্রায় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং সার্বিকভাবে জঙ্গি দমনে অত্যন্ত সহায়ক হবে। স্বল্প ও সীমিত সম্পদ নিয়ে ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে বাংলাদেশের জন্য এখন বিশাল আকারের বিদেশি বিনিয়োগ ও সাহায্য দরকার। সব দিক বিবেচনা করে সেটি শুধু আসতে পারে ও নেওয়া যেতে পারে চীনের কাছ থেকে। তাই বাংলাদেশ আজ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য বজায় রেখে চীনের বিশাল বিনিয়োগ আনতে সক্ষম হয়েছে, সেটি বজায় রাখা ও আরো বৃদ্ধি করার জন্য বিআরআইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযুক্তির সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী। ভারতও এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে। তাই চীন ও ভারতের সঙ্গে সমানতালে সম্পর্ক বজায় রাখলে তাতে কোনো দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হবে না, বরং তা হতে পারে আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার অনুঘটক।
উপসংহারে বলতে চাই, এশিয়ায় যে বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে তার পরিপূর্ণ ও সফল বাস্তবায়নে চীন-ভারতের সমঝোতা ও সহযোগিতা সবার কাম্য হওয়া উচিত।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক