Wed. Apr 23rd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

21kআলী যাকের ।। খােলা বাজার২৪।। বুধবার , ৭ জুন, ২০১৭: চারদিকে এত বেদনাদায়ক ঘটনার সমাগম যে থিতু হয়ে বসে হৃদয়নন্দন বনে উচ্চারিত আনন্দঘন কথা বলার সুযোগ কোথায় আমাদের এই বাংলাদেশে? একটু বোধ হয় ভুল বললাম। বলা উচিত ছিল সুযোগ কোথায় আজকের এই অস্থির বিশ্বে? কিছুদিন আগে আমার এক ঘনিষ্ঠজনের কাছ থেকে টেলিফোন এসেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে তার নিবাস। আমাকে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আসবে নাকি এই শরতে আমাদের দেশে?’ ও জানে, যেকোনো শীতের দেশের শরৎকাল বড় হৃদয়গ্রাহী হয়, বর্ণময় হয়। এবং আমি অতীতে অনেকবার এই শরৎ দেখার জন্যই শুধু কোনো না কোনো অজুহাতে শীতপ্রধান দেশ ভ্রমণ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রে আটলান্টিক সাগর ঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে যে পথ, তার উভয় পাশে এক নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি হয় শরতে। মার্কিনরা শরৎকালকে Fall বলে। এর কারণ বোধ হয় এই যে ওই সময়েই সব বৃক্ষরাজির এমনকি ছোটখাটো গাছগাছালিরও পাতা পড়তে শুরু করে। এবং ওই পাতা পড়ার মধ্যেই নিহিত থাকে ধূসর শীতকালের আগমন বার্তা। তখন সব মানুষ তীব্র ঠাণ্ডায় বেঁচে থাকার সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গাছপালা সব পত্র-পুষ্পহীন হয়ে যাবে, তুষারপাত শুরু হবে, রাস্তাঘাটে চলাফেরা কঠিন হয়ে পড়বে। আমি আমার বন্ধুটিকে বললাম, ‘না, এবারে আর যাচ্ছি না। ’ বন্ধুটি জিজ্ঞেস করল, ‘কেন?’ আমি তাকে বললাম, ‘মনটি ভারি বিষণ্ন। ’ ও ধরেই নিয়েছিল যে আমাদের মতো বাংলাদেশিদের মন বিষণ্ন হতে পারে শুধু দেশে বিরাজমান পরিস্থিতির জন্যই। তাই জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? মন খারাপ করা কিছু কি ঘটেছে নাকি দেশে সম্প্রতি? জবাবে আমি বললাম, ‘ঘটছে তো প্রত্যহই। তবে এ আর এমনকি! সারা বিশ্বে যে বহমান অস্থিরতা, তারই তরঙ্গ ওঠে আমাদের জলাভূমিতেও। এ-ই তো বিষয়। ’ সে বলল, ‘হেঁয়ালি রেখে আসল কথা বল কী হয়েছে?’ জবাবে আমি বললাম, ‘দায়ী তো তোমরাই!’

অতঃপর এর ব্যাখ্যা দিতে হলো। কেননা আমার বন্ধুটি মনে করল যে আমার এই সরাসরি জবাব আরো বেশি হেঁয়ালিগ্রস্ত। আমি তাকে বলেছিলাম যে বিশ্বের যেখানে যা-ই ঘটুক না কেন, তার পেছনে মার্কিন সরকারের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ উসকানি একেবারে পরিষ্কারভাবে কাজ করে। আজ থেকে বহু বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে অকস্মাৎ জীবনবিধ্বংসী অ্যাটম বোমা নিক্ষেপ থেকে শুরু করে কোরিয়া কিংবা ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট নিধনের অজুহাতে যে হত্যাযজ্ঞ, এবং এরপর কিউবার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যে আগ্রাসন, ওদের লেজের কাছে অবস্থিত লাতিন আমেরিকায় মার্কিনদের যে গণবিরোধী ভূমিকা—এসব তো আজ ঐতিহাসিক সত্য হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। এবং বিভিন্ন সময় মার্কিন সরকারের সৃষ্ট এসব বিরোধে তাদেরই পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। তা জেনেও তারা একের পর এক ভিন্ন ভিন্ন স্থানে নতুনতর ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পর্যন্ত যে অস্থির অবস্থা ও হানাহানি আজ প্রতিদিনের সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, এর সবই এককভাবে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বোধ করি এর প্রধান কারণ হলো যে রাজনীতিতে আজ ভারসাম্য রক্ষা করার মতো কোনো দ্বিতীয় পরাশক্তি আর নেই। অতএব যুক্তরাষ্ট্র যা বলে কিংবা করে, সেটাকেই বৈধ বলে ধরে নিতে হয়। দুর্মুখেরা বলেন যে এর পেছনে ওই পরাশক্তির নিজস্ব লাভ-লোকসানের প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ইরাকে যুদ্ধ, লিবিয়ায় গাদ্দাফির শাসনের অবসান, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ কিংবা ইরানকে হুমকি-ধমকি এসবের পেছনেই নাকি রয়েছে তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য বিস্তারের অভীপ্সা। যাতে করে ভবিষ্যতে তেল নামক অতিপ্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ দাহ্য পদার্থটির কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে কারো কাছে হাত পাততে না হয়। মুক্তচিন্তার অর্থনীতিবিদরা, যাঁরা নব্য-ধ্রুপদী অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে মোটামুটি সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক ও স্বনির্ভর অর্থনীতির ধারক ও বাহক, তাঁরা এ কথা বলেন। এবং বলাই বাহুল্য, এসব অর্থনীতিবিদ যুক্তরাষ্ট্রের তল্পিবাহক নন। হতে পারে এটিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত পরিকল্পনা। তবে আপাতদৃষ্টিতেও যা দেখা যায়, তাতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ বুঝতে পারি যে তাদের সব কৌশলই আসলে ভ্রান্ত অনুমানের ওপর নির্ভরশীল। অতএব এখন যখন তারা ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে, তখন আমাদের না হেসে উপায় থাকে না। মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশগুলোকে একের পর এক মার্কিনরা ধ্বংস করেছে, একবার সেগুলোর দিকে তাকাই।

ইরাকের সাদ্দাম হোসেন অবশ্যই স্বৈরাচারী, একনায়ক ছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধি। তাঁকে হত্যা করে ইরাকে ধর্মীয় মৌলবাদকেই উসেক দিয়েছে মার্কিনরা। লিবিয়ার সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। আর যা-ই হোক না কেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফি কখনোই ধর্মান্ধ ছিলেন না। তবে স্বৈরাচারী একনায়ক ছিলেন, এ কথা অনস্বীকার্য। সেখানেও কিন্তু তাঁর বিনাশের পর আমরা উগ্র ধর্মান্ধতার উত্থান দেখতে পাই। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ অবশ্যই একজন অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ, যিনি তাঁর হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব বোধ করেন। তাঁকে সরিয়ে দিয়েও ওই একই ঘটনা সেখানে ঘটবে। আফগানিস্তানে তালেবান সৃষ্টির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রই মূল ভূমিকা পালন করে এবং এই পরিকল্পনা কার্যকর করে তারা পাকিস্তানের আইএসআইয়ের সাহায্য নিয়ে। প্রথম ছিল যারা মুজাহিদীন, তাদের সরিয়ে দিয়ে এলো তালেবান। বস্তুতপক্ষে ওসামা বিন লাদেনও পরোক্ষভাবে যুক্তরাষ্ট্রেরই সৃষ্টি। যদি এটাই সত্য হবে যে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মার্কিন প্রশাসন বিশ্বময় একনায়কত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে, তাহলে তো সংগত কারণেই তাদের সহায়তা করতে হতো এসব দেশে সেসব রাজনৈতিক নেতাকে, যাঁরা গণতান্ত্রিকভাবে স্বৈরাচার হটাতে পারে। সৌদি আরব ও কুয়েত—এ দুটি দেশ কখনোই গণতান্ত্রিক ছিল না। তাদের শাসনকর্তারা অবশ্যই একনায়কত্বে বিশ্বাস করেন এবং নিজের প্রজাদের কঠোরভাবে দমন-পীড়ন করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কখনোই কোনো অভিযোগ নেই। তাহলে কি এ কথা সত্য বলে মেনে নিতে হবে যে ওই সব গণমানুষবিচ্ছিন্ন সম্রাট ও শাসকরা যুক্তরাষ্ট্রকে তোষণ করে চলেন এবং নিয়মিতভাবে ভ্যাট দিয়ে থাকেন? মার্কিনদের ন্যক্কারজনক আরো একটি দিক সম্পর্কে এখানে না বললেই নয়। পাকিস্তানকে তারা সব সময় ব্যবহার করে এসেছে তাদের গোপন দুরভিসন্ধিগুলো সফল করার জন্য। এ কারণেই আজ পাকিস্তান নিজেদেরই জনগোষ্ঠীর একাংশ দ্বারা নিয়ত হানাহানির আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। অথচ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সব সমর্থন গুটিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ কাজের সময় কাজি…!

এই যে নিজ স্বার্থের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অবিবেচনাপ্রসূত ভূমিকা, এর দ্বারা আপাত শান্ত ও গণতন্ত্রমনা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রগুলোতেও আস্তে আস্তে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। ভারত কিংবা বাংলাদেশ অথবা মিয়ানমার কিংবা শ্রীলঙ্কাও এই দুর্গতির বাইরে নয়। আজকের বিশ্বে একমাত্র পরাশক্তি তার নিজের স্বার্থ সংরক্ষণে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে একের পর এক, তার ফলে আমাদের সবার জীবনে একধরনের অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে। আমরা চাই না পত্র-পুষ্প-পল্লবিত আমাদের এই দেশগুলো শরৎ শেষে ধূসর, বরফাচ্ছন্ন জনপদে পরিণত হোক। আমরা সবাই জানি যে বিশ্বায়নকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে সব পরাশক্তি আমাদের ওপর সর্বদাই ছড়ি ঘোরাচ্ছে। সেই বিশ্বায়নেরই সুযোগ গ্রহণ করে আমাদের বিশ্বের সব মানুষের সঙ্গে একটি সংযোগ স্থাপন করতে হবে, ঠিক যেমন ১৯৭১ সালে আমরা করেছিলাম। সে সময়ের মার্কিন সরকার যতই বাংলাদেশবিরোধী হোক না কেন, মার্কিন জনগণ বাংলাদেশিদের পাশেই এসে দাঁড়িয়েছিল। নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ থেকে যে আহ্বান এসেছিল, সেটাই কবিতার খাতায় রূপান্তরিত হয়েছিল তখনকার আমেরিকার প্রধান কবি অ্যালেন গিনস্্বার্গের সেপ্টেম্বর ইন যশোর রোড কবিতায় এবং কবিতার পাতা থেকে সব স্বাধীনচেতা, গণতন্ত্রমনা মার্কিন জনগণের হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই আহ্বান। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সর্বতোভাবে আমেরিকার অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেনের জনগণের সচেতনতা বাংলাদেশের পক্ষে এক দুর্মর সমর্থন গড়ে তোলে।

আসলে যেকোনো সমাজে সুস্থচিন্তার মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অতএব যেকোনো দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রে বিশ্বময় সব জনগণের মধ্যে আমাদের গড়ে তুলতে হবে এক সংবেদনশীল সম্পর্ক। তবে সবচেয়ে বড় কথা, যেকোনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছে আজকের মানুষ, এমনকি পাকিস্তানের স্বাধীনচেতা কিশোরী মালালা ইউসুফজায়ীও। তাকে নিষ্ঠুর তালেবানরা গুলিবিদ্ধ করলেও বিদ্যার্জনে তার যে অবস্থান, তাতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এভাবে ভালো মানুষ ক্রমেই উচ্ছেদ করবে কতিপয় খারাপ মানুষকে। আমরা অত সহজে হেরে যাব না। দুনিয়াটা অত সহজে ধ্বংস হওয়ার নয়।

লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
[সংকলিত]