খােলা বাজার২৪।।শনিবার, ২৪ জুন, ২০১৭: বছর খানিক আগে সৌদি আরবের একটি টিভি চ্যানেলে আলেমগণ লাইভ প্রশ্নোত্তর দিচ্ছিলেন। একটি ফোন এলো সোমালিয়া থেকে। জনৈক দর্শক জানতে চাইলেন, আমাদের এখানে খুব খাদ্যাভাব চলছে। কিছু রোজাদার এমনও আছি যারা সাহরিতে কিছু খাইনা, ইফতারেও আমাদের খাওয়ার কিছু থাকে না। কয়েকদিন পর পর আমরা মুখে দেয়ার মত কিছু পেয়ে থাকি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে সাহরি ও ইফতার ছাড়া কি আমাদের রোজা হবে? উত্তরদাতা আলেম, যিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মসজিদে নববীর মুফতি প্যানেলের সদস্য, এর কোন উত্তর না দিয়ে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এমন রোজাদারও মুসলিম বিশ্বে রয়েছে, তারা কারো কাছে খাদ্য সাহায্য চাইছে না বরং এভাবে খাবার না খেয়ে রোজা হবে কিনা জানতে চাইছে। এর জবাব কী হতে পারে?
তাদের রোজা তো অবশ্যই হবে। তবে এদের খোঁজ খবর না রাখায় সক্ষম ও ধনী মুসলমানদের ঈমান থাকবে কিনা বা রোজা হবে কিনা সে প্রশ্নই মুখ্য। কান্নার এ দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের বহু দর্শক তাদের সাহায্য-সহযোগিতার পথ খুঁজে বের করেন। তাছাড়া, অনেকে বিলাসবহুল ইফতারির ছবি ফেসবুক ইত্যাদিতে পোস্ট না করার প্রচারণা শুরু করেন। আজকে ইরাকের মসুলে মানুষ গাছের পাতা ও বালি খেয়ে ইফতার ও সাহরি করছে। মুসলিম বিশ্বে এ অবস্থাই এখন চরম বাস্তবতা। ইনকিলাব ২০/৬/২০১৭
মুসলমানরা যখন অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করেছেন তখন ধনী আরব দেশগুলো কী পরিমাণ অর্থ মার্কিনিদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যয় করছে তা ভাবতেও অবাক লাগে! সৌদি আরব অস্ত্রচুক্তিসহ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামগ্রিক ৪০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে আরব-আমেরিকান ইসলামী সম্মেলন করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ উপহারই দিয়েছেন ১ বিলিয়ন ডলারের।
কোথায় ইসলামী চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, আরব ঐতিহ্য? কাতার বৃটেনে যে সম্পদ করেছে তার পরিমাণ বৃটেনের রানীর সম্পদের চেয়েও বেশি। এর আগে লিবিয়া ও ইরাক কত সম্পদ জমা করেছিল ইউরোপে? ধ্বংস ও পতনের সময় এসব কি কোন কাজে লেগেছে? সৌদি আরব স্পেন, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে যত টাকা ব্যয় করেছে তার কোন লাভ কী তারা আদৌ পাচ্ছে? ইসরায়েলের সাথে সৌদী আরবের ব্যবসায়িক চুক্তি, কূটনৈতিক সম্পর্ক দিন দিন উন্নতির দিকে। যে ইসরায়েল মুসলমানদের প্রথম কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস জোরপূর্বক দখল করে আছে, জাতিসংঘের বাধা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দার মুখেও ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে নিজেদের বসতি বৃদ্ধি করছে, ফিলিস্তিনিদের পাখির মতো যত্রতত্র গুলি করে মারছে, অগণিত মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন করছে। তাদের সাথে সৌদিআরবের সখ্যতা সত্যিই লজ্জাজনক।
অথচ মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, মুসলমানরা পরস্পরের ভাই ও বন্ধু। তারা যেন মুসলমানদেরেই বন্ধু ও অভিভাবকরূপে বেছে নেয়। আল্লাহ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, তোমাদের উপর ইহুদী-নাসারারা কোনদিনই খুশি হবে না যতক্ষণ না তোমরা তাদের দলভুক্ত হয়ে যাও। এই দৃশ্যই দেখা গিয়েছে কাতারের সঙ্গে সৌদি আরবসহ পাঁচ আরব দেশে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর। ইসরায়েল এই ঘটনায় নিজের আনন্দ প্রকাশ করতে দ্বিধা করেনি। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে এটিই প্রমাণিত হয়েছে যে ইসরায়েল মুসলিমদের শত্রু নয়। এখন আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
মহান রাব্বুল আলামিন মুসলমানদের পরস্পর ঐক্যবদ্ধভাবে থাকতে আদেশ দিয়েছেন। আর বিচ্ছিন্নতাকে পরিহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, তোমরা আল্লাহর রজ্জু ধর ঐক্যবদ্ধভাবে। এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। (আল-কোরআন)। কিন্তু সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতি দেখে প্রশ্ন জাগে, তারা কাদের নীতি অনুসরণ করছেন। একসময় ব্রিটেন সা¤্রাজ্য ছিল বিশ্বজুড়ে, নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য তারা ‘ভাগ কর-শাসন কর’ নীতির বাস্তবায়ন করেছিল। ‘চীন-জাপান শত্রু, জার্মান -ফ্রান্স শত্রু, শিয়া-সুন্নী শত্রু’ এই জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক যে মনোভাব মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল তা আজও বিদ্যমান। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে যা সুস্পষ্ট। মুসলিমরা নিজেরাই একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে। নিজের ভাইদের মারার জন্য অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে। ব্রিটিশরা যে বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছে তা থেকে মুসলিম বিশ্ব নিজকে রক্ষা করতে পারে নি।
মুসলিম উম্মাহ ‘এক প্রাণ, এক দেহ’ এই চেতনাবোধ আজ বিলুপ্ত প্রায়। ইসলামে মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের। এ সম্পর্কের ভিত্তি ইসলামের একটি স্তম্ভের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে কেউ তার স্বীকৃতি দেবে সেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে রাসূল সা: জোর তাগিদ দিয়েছেন। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া, অনুগ্রহ, মায়া-মমতার দৃষ্টিকোণ থেকে তুমি মুমিনদের দেখবে একটি দেহের মতো। যদি দেহের কোনো একট অংশ আহত হয়ে পড়ে তবে অন্যান্য অংশও তা অনুভব করে’ (বুখারি ও মুসলিম)।
আজ ইয়ামেনে দুর্ভিক্ষ, ইরাক-আফগানিস্তানে সহিংসতার কারণে ক্রমাগত মানুষ মরছে, বিধ্বস্ত সিরিয়া। অথচ সৌদি ও বাহরাইনের ক্রাউন প্রিন্সরা ট্রাম্প পরিবারের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় অনাহারে থাকা মানুষগুলোর জন্য তাদের প্রাণ কাঁদে না। অন্যদিকে ইভানকা ট্রাম্পের মিষ্টি সুরের অনুরোধ রক্ষার্থে তারা তাৎক্ষণিক ১০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিতে পারেন। কৌতুহল জাগে, মুসলিম দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতি কাদের স্বার্থ রক্ষা করে?
অথচ আরব জাহান এখন নিজেদের ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখার জন্য লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্তের হোলি খেলায় মত্ত সাম্রাজ্যবাদি শক্তির পদলেহনে মত্ত। লৌকিকতা দেখানো ধর্মীয় রীতি-নীতি ইসলাম নয়। ইসলাম ভাতৃত্ব, মানবতা, সহনশীলতা, ঐক্যবদ্ধতা ও শান্তিপূর্ণ বিশ্বের কথা বলে।