আবু আহমেদ
খােলা বাজার২৪।। বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭: রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ চুপচাপ থাকলে বা আওয়াজ দুর্বল হলে মিয়ানমার সরকার নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেবে। রাখাইন রাজ্য থেকে সব মুসলমানকে বের করে দিয়ে তারা জাতিগত শুদ্ধতা সৃষ্টির নীতি গ্রহণ করেছে। এবং সত্য হলো, মিয়ানমার সরকার তাদের এই নীতিতে সফলও হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে একেবারে চুপ তা নয়, তবে তারা কতটা প্রতিবাদমুখর হবে তা অনেকটা নির্ভর করছে বাংলাদেশ এই ইস্যুতে কতটা প্রতিবাদী হয় তার ওপর। বাংলাদেশ যদি রোহিঙ্গা ইস্যুকে একটা গ্লোবাল ইস্যু বানাতে পারে, তাহলেই কেবল রোহিঙ্গা ইস্যুটির একটা সম্মানজনক সমাধান হতে পারে। এটা চিন্তা করা ঠিক হবে না যে অন্য কেউ রোহিঙ্গা ইস্যুকে গ্লোবাল ইস্যু বানাবে আর বাংলাদেশ তাতে মৌন সমর্থন দিয়ে যাবে। যদি বাংলাদেশ এই ইস্যুতে কোনো সক্রিয় উদ্যোগ না নেয়, তাহলে বিশ্ব ভাববে এটা বাংলাদেশের নিজের সমস্যা এবং তারা শুধু রোহিঙ্গা ইস্যুকে একটা শরণার্থী সমস্যা হিসেবেই দেখবে এবং তাদের ভরণ-পোষণের জন্য সাময়িক কিছু সাহায্য পাঠাতে পারে। বস্তুত রোহিঙ্গা ইস্যুটি শুধু শরণার্থী সমস্যা নয়, এটা হলো একটা নীতির সমস্যা।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ইস্যুটি কোনো অস্থায়ী রিফিউজি সমস্যা হতে পারে না। যা ঘটছে এবং মিয়ানমার সরকার যে ঘটনাকে আন্তর্জাতিক মহল থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে তা রীতিমতো জাতিগত নিধন। শুধু ধর্ম ও ভাষার কারণে বহু বছর থেকে বাস করে আসা লোকগুলোকে আজকে নিধন-হত্যার মাধ্যমে তাদের স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে।
কোনো জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা স্বেচ্ছায় কখনো ভিটেমাটি ফেলে অন্য দেশে আশ্রয়শিবিরে আশ্রয় নেয় না। মিয়ানমার সরকার যে কত জঘন্য হতে পারে তা তো বোঝা যায় যখন তারা অন্য কোনো দেশের লোকদের রাখাইন রাজ্যে কী ঘটছে তা দেখতে দিতে দেয় না। আজকে রোহিঙ্গাদের কথা শোনার কোনো লোক মিয়ানমারে নেই। যে দু-চারটি কণ্ঠ ছিল তাদের কথা বলা থেকে দূরে রাখা হয়েছে। সেখানে যে মানবতার ওপর বর্বরতম হামলা হচ্ছে সেটা প্রত্যক্ষ করার জন্য তৃতীয় পক্ষের কাউকেই রাখাইনে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। মিয়ানমার সরকারের নীতি হলো মারো কাটো, তবে চুপেচাপে। এই ইস্যুকে তারা ইস্যু বলেই মনে করে না।
রোহিঙ্গারা রাখাইনে অনুপ্রবেশ করেনি। বরং তাদের রাজ্যে অন্য বার্মিজরা অনুপ্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গারা রাখাইনের স্বাধীন বাসিন্দা। তারা মিয়ানমারের নাগরিক, সেখানে তারা অনেকবার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াসহ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। হঠাৎ মিয়ানমার সরকার বলা শুরু করল, এই লোকগুলো বাইরে থেকে এসেছে। আজকে তারা বলছে, যেসব রোহিঙ্গার পরিচয়পত্র আছে শুধু তাদেরই তারা ফেরত নেওয়ার কথা ভাববে। কিভাবে সব রোহিঙ্গা পরিচয়পত্র পাবে? তাদের তো স্বীকৃতিই দেওয়া হচ্ছে না। কোনো জাতিগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব এবং পরিচয়পত্র না দিয়ে যদি বলা হয় যে তারা ওই দেশের কেউ নয়, সেটা কিভাবে গ্রহণযোগ্য বিষয় হতে পারে? ধর্মের ও ভাষার ভিত্তিতে যদি বিতাড়নের উদাহরণ একবার প্রতিষ্ঠা লাভ করে ফেলে, তাহলে সারা বিশ্বে এমন ঘটনা আরো ঘটতে পারে। আমাদের বাপ-দাদাদেরও অনেকে জীবনের বড় অংশ বার্মা কাটিয়ে এসেছেন। বার্মা অল্প সময়ের জন্য ব্রিটিশ কলোনি ছিল। তখন ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল থেকে অনেক লোক চাকরি এবং কাজ করার জন্য বার্মা যেত। সাহিত্যিক শরত্চন্দ্রও বার্মায় চাকরি করেছেন।
রাখাইনের পূর্ব নাম ছিল আরাকান। আরাকান সড়ক নামে একটি সড়কও বাংলাদেশ থেকে আরাকানের দিকে নির্মিত হয়েছিল। আরাকান-আকিয়াবের সঙ্গে এই দেশের পরিচিতি শত শত বছরের পুরনো। একসময় আরাকানে মুসলিম শাসন ছিল। সেই ঐতিহাসিক সূত্র ধরে এই দেশের লোক আজকের রাখাইন রাজ্যে চলাচল করত। রাখাইনে মুসলমানদের মসজিদ-মাদরাসা আছে। এবং ওইগুলো অনেক পুরনো। এমন নয় যে হঠাৎ কিছু লোক রাখাইনে গিয়ে তাদের রাখাইনবাসী বলছে। বরং রাখাইনে নতুন লোক যদি এসে থাকে তারা এসেছে বার্মার মূল ভূখণ্ড থেকে, দক্ষিণাঞ্চল থেকে।
রাখাইনে যে অমানবিক নিধন চলছে এটা বন্ধ করার জন্য দু-চারবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে এনে প্রতিবাদ করলে কোনো কাজ হবে না। আমাদের আওয়াজটাকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে যেতে হবে। আমরা যদি শুধু ঢাকায় বসে মৃদু প্রতিবাদ করতে থাকি, তাহলে আমাদের কথা কেউ শুনবে না। আমাদের সরকারকে আরো সক্রিয় হতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে উচ্চৈঃস্বরে। বলতে হবে যে বিশ্ববাসী তোমরা দেখে যাও কিভাবে বার্মিজ সরকার শুধু ধর্ম-ভাষা ভিন্ন হওয়ার কারণে তাদের নিধন করে চলেছে। তাদের শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে এই উদ্দেশ্যেই, যাতে তারা বড় হয়ে এই নিধনের ইতিহাস না জানে। আজকে বাংলাদেশ প্রতিবাদ না করলে অন্য যারা এই ইস্যুতে প্রতিবাদ করছে তারাও থেমে যাবে। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায় যে যুক্তরাজ্য সরকার রোহিঙ্গা ইস্যু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু সেই উদ্যোগ কাজে আসবে না যদি বাংলাদেশ চুপ থাকে। অন্যরা তখন বলার সুযোগ পাবে, যে দেশে শরণার্থী আসছে সেই দেশ কেন চুপ আছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুকে শক্তভাবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এজেন্ডাভুক্ত করে এ ক্ষেত্রে একটা সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের পক্ষে চেষ্টা করা উচিত। এরই মধ্যে তো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ইস্যুতে নিউ ইয়র্ক থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এটাকে কয়েক লাখ লোকের শরণার্থী সমস্যা হিসেবে দেখলে ভুল করবে।
এখন রাখাইনে যা হচ্ছে, তা রীতিমতো গণহত্যা। আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে এই ইস্যুকে গণহত্যা-জাতিগত নিধন হিসেবে তুলে ধরতে হবে। অন্য কথা হলো, রোহিঙ্গাদের বার্মিজ নাগরিকত্বের বিষয়টিকেও বাংলাদেশকে তুলে ধরতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি সংকটের মূলে না যাই, তাহলে বিষয়টি কয়েক লাখ লোকের শরণার্থী সমস্যা হিসেবেই থেকে যাবে। এতে বাংলাদেশ হয়তো বিশ্বের কোনো কোনো দেশ থেকে কিছু অর্থকড়ি বা অন্য মানবিক সাহায্য পেতে পারে, কিন্তু এই সমস্যার সমাধান হবে না। আজকে বাংলাদেশ আওয়াজ তুলতে ব্যর্থ হলে একদিন এসব রোহিঙ্গা তাদের মাতৃভূমি রাখাইনকে ভুলে যাবে। তারা শরণার্থী হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিবিরেও বসে থাকবে না। তারা বাংলাদেশের অন্য লোকের সঙ্গে মিশে যাবে। এবং একদিন এমন হতে পারে যে এই ইস্যুটিকে সবাই ভুলে গেছে। মিয়ানমারও ঠিক তাই চাচ্ছে। আমরা আশা করব, বাংলাদেশের সরকারপ্রধান এ বিষয়টি আন্তর্জাতিকীকরণে আরো সক্রিয় হবেন। অন্তত বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘসহ অন্য সব মহলকে বৈঠক ডেকে চিঠি লিখে অবহিত করতে হবে। আমরা শেষ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিকদের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে নিয়ে গেছি, তবে তা আরো আগেই করা উচিত ছিল। অন্য অনেক ছোট ইস্যুতে আমরা অনেক হৈচৈ করি। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের কেন যেন একটা অবহেলার ভাব আছে। আমাদের তো উচিত ছিল, এরই মধ্যে বৃহৎ শক্তিবর্গকে এ বিষয়ে অবহিত করা।
ভারত অন্য কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের অবস্থানকে কিছুটা সমর্থন দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভারত সরকারের কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে। চীন-ভারতের বড় ব্যবসা বাংলাদেশেও আছে। আমরা মনে করি, চীন-ভারত সংগত কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের বিরোধিতা করবে না। যারা মনে করেছিল অং সান সু চি মানবিক হবেন, তাদের ধারণা মিথ্যা প্র্রমাণিত হয়েছে। বরং এই সু চি সামরিক জান্তা থেকেও জঘন্য।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়