Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

বিনিয়োগবিদ্যার অভাব আছে বটে তবে বড় অভাব ভালো শেয়ারেরআবু আহমেদ – খােলা বাজার২৪। রবিবার, ২২ অক্টোবর ২০১৭: গত দুই মাসে ঢাকার শেয়ারবাজারের মূল্যসূচক বেশ না বাড়লেও মোটামুটি বেড়েছে। সূচক পাঁচ হাজার ৮০০ থেকে ছয় হাজার ২০০-তে যেতে বেশি সময় নেয়নি।
অনেকের কাছে ছয় হাজার পয়েন্টের সূচক শেষ প্রান্ত বলে মনে হয়েছিল; কিন্তু তাঁদের ধারণা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে। মূল্যসূচক আরো ২০০ পয়েন্ট অতিরিক্ত বেড়েছে। শেয়ারের মূল্যসূচক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি কেউ বলতে পারে না। আবার বাড়ার চক্রে কোথায় গিয়ে শেষ হবে, সেটিও কেউ বলতে পারে না।

অনেক উপাদান শেয়ারের মূল্যকে প্রভাবিত করে, যার মধ্যে এককভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো যেসব শেয়ারের মূল্য বাড়ছে সেগুলোর আয়-অর্জন ও সেগুলো সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের ভবিষ্যৎ ধারণা। তবে সত্য হলো, বেশির ভাগ কম্পানির ভবিষ্যৎ ব্যবসা ও আয় সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের ঋণাত্মক ধারণা রয়েছে, বিশেষ করে ওই সব কম্পানির ক্ষেত্রে যেগুলোর উদ্যোক্তারা এরই মধ্যে তাঁদের অংশ থেকে বড় পরিমাণের শেয়ার বেচে দিয়েছেন। অনেক উদ্যোক্তার এখন শেয়ার বলতে তেমন কিছুই নেই। তবুও তিনি ম্যানেজমেন্টে বসে কম্পানিকে শোষণ করে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চলেছেন। জিজ্ঞেস করার কেউ নেই।
রেগুলেটর আছে বটে। তবে রেগুলেটর মহাশয় অন্য কাজে অনেক বেশি ব্যস্ত। আজকাল রেগুলেটর বিনিয়োগ শিক্ষার ওপর খুব জোর দিচ্ছেন। বাণীটা হলো—আপনারা জানুন, বুঝুন, তারপর বিনিয়োগ করুন। ভালো কথা! বিনিয়োগবিদ্যা অনেক বিনিয়োগকারীরই নেই। তাঁরা কোনো বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বিনিয়োগতত্ত্ব ও পোর্টফোলিও ম্যানেজমেন্টের এ, বি, সি-ও শেখেননি। তবে কিছু বিনিয়োগকারী আছেন, যাঁরা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। ঠকতে ঠকতে তাঁরা এখন অনেক শিখেছেন। আবার কিছু আছেন, অনেক দিন শেয়ারবাজারে থেকেও যেন কিছুই শেখেননি। অভিজ্ঞতাও তাঁদের শেখাতে পারেনি। তাঁরা কিছু না শেখার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

রেগুলেটর BSEC-র শিক্ষা উদ্যোগ ভালো; তবে অনেক লোককে এ ক্ষেত্রে শিক্ষিত করেও লাভ নেই। কারণ হলো, তাঁরা যখন বাড়তি অর্থ নিয়ে বাজারে আসবেন, তখন দেখবেন বাজারে বিনিয়োগ করার মতো উপযুক্ত শেয়ার খুবই কম। দেখবেন বাজার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে জুয়ার মাধ্যমে। তখন তাঁদের শেখানো বিদ্যা কোনো কাজেই আসবে না। অন্য কথা হলো বিনিয়োগবিদ্যা কি এতই সহজ যে দু-চারটি বক্তৃতা থেকে শেখা যাবে! হতেই পারে না। বস্তুত এ বিদ্যা রপ্ত করতে হলে অনেক পড়তে হবে, অনেক গবেষণা করতে হবে। সারা জীবনই এ বিদ্যার পেছনে ছুটতে হবে। বিনিয়োগবিদ্যায় অনেকেই নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তবে তাঁরা সবাই অধ্যাপক-গবেষক। ওয়াল স্ট্রিটের (Wall street) ম্যাগনেটরা কেউ নোবেল পুরস্কার পাননি। এর অন্য অর্থ হলো বিদ্যার বাস্তব প্রয়োগ এক জিনিস আর ভালো তত্ত্ব দাঁড় করানো আরেক জিনিস। বাংলাদেশের অনেক লোককে বিনিয়োগবিদ্যা শেখানো যেতে পারে। তবে এতে বিপদও হতে পারে। এক সপ্তাহ শিখে কেউ যদি মনে করে সে অনেক জেনে ফেলেছে, তাহলে সেটা মারাত্মক ভুল হবে। আবার শিক্ষিত লোকদের বিনিয়োগবিদ্যার মতো কঠিন বিদ্যা শেখাতে গেলে তাঁরা ভুল বুঝতে পারেন। সব লোকের জন্য সব বিদ্যা উপযুক্ত নয়। শুধু যাঁরা স্ব-আগ্রহে এই বিদ্যা শিখতে চান, তাঁদেরই এ বিদ্যা শিখতে আমন্ত্রণ জানানো যায়।

আর বিদ্যাটা কী? বইতে এর ব্যাখ্যা আছে। যাঁরা এসব জানেন আর পড়ে অনেক আলোচনা করেন, তাঁরাই এ লাইনে শিক্ষিত হয়েছেন বলা চলে। তবে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তত্ত্ব ও উপাত্তগুলো কি সঠিক আছে, না তৈরি করা উপাত্ত— পরিসংখ্যানকে সামনে হাজির করা হয়? আসল কথাটা আমার মতো লোক সুযোগ পেলেই বলতে থাকি। সেটা হলো ছোট্ট এই শেয়ারবাজারের গভীরতা কিভাবে বাড়ানো যায়। দুঃখ হলো বিনিয়োগ সপ্তাহে এত এত সেমিনার হলো, কোথাও কি এই বাজারে আরো ভালো শেয়ার কিভাবে আনা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে? অর্থমন্ত্রী একটি সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন। অন্তত রেগুলেটর তো ভালো শেয়ারের জোগানের যে অভাব আছে, সেদিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত, যার হাতে ঘরের চাবি, তাকে না ডেকে যদি অন্যরা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করি, তাহলে দরজা কি খুলবে? শুনলাম এক সেমিনারে বক্তব্যটা এলো এভাবে যে ভালো কম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনার দায়িত্ব মার্চেন্ট ব্যাংক বা ইস্যু ম্যানেজারদের। ভালো কথা; কিন্তু তারা কি এ কাজে সফল হবে সরকারের পলিসি সাপোর্ট ছাড়া? যাঁরা ভালো কম্পানিকে শেয়ারবাজারে না এনে শুধু মূল্যসূচককে বাড়াতে চাচ্ছেন, তাঁরা পুরো বাজারকেই বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তাঁরা কি বুঝছেন না যে তাঁরা ঘোড়ার আগেই গাড়িকে দাঁড় করাচ্ছেন।

শেয়ারবাজারে কিছু সংস্কার তো অবশ্যই হয়েছে। তবুও বলব BSEC-র যে মানের রেগুলেশন করার কথা সেটা আজও দেখছি না। কিছুদিন আগ পর্যন্ত মার্জারের বা একীভূতকরণের নামে অতটা বিদ্যায় কম নয়—এমন বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কিছু কম্পানি প্রতারণা করেছে। এমন কম্পানির সঙ্গেও রেগুলেটর মার্জ হতে অনুমতি দিয়েছে যে কম্পানির IPO-তে আসার যোগ্যতাই ছিল না। কসমেটিক-সাবান কম্পানির সঙ্গে মার্জ হতে অনুমতি দিয়েছে কটন-স্পিনিং কম্পানিকে। পূর্বোক্তটি স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কম্পানি আর পরের কম্পানিটি একই উদ্যোক্তার; তবে ঋণখেলাপি। এখন তো কম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের বার্ষিক সাধারণ সভা বলতে কিছু হয় না। কিছু লোক, সংখ্যায় হবে হয়তো ডজনখানেক, সভায় গিয়ে বলে পাস পাস। আর অমনিই সাত-আট মিনিটের মধ্যে সব এজেন্ডাই শেষ হয়ে যায়। শোনা কথা, কম্পানি এই পাস পাস পার্টির পেছনে ক্ষেত্রভেদে ১০-১২ লাখ টাকা খরচ করে। সবই তো BSEC-র জানার কথা। শেয়ারহোল্ডারদের AGM একটি গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। এটাকে সফল করার জন্য এবং পাস পাস পার্টির কবল থেকে উদ্ধারের জন্য BSEC কী করছে, সেটা জানতে ইচ্ছা করে।

এ লেখার প্রথমেই বলেছিলাম, কোনো শেয়ারের মূল্য বাড়বে কি কমবে, সেটা মূলত নির্ভর করে ওই কম্পানির ব্যবসায়িক অর্জনের ওপর এবং ওই কম্পানি তাদের অন্য বিনিয়োগকারীদের ন্যায়মতো লভ্যাংশ দেয় কি না। আরো একটা কথা বলেছিলাম, কোনো কম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদের (Expectation) জন্ম হলে ওই কম্পানির শেয়ারের মূল্য বাড়বে। এ ক্ষেত্রে অন্য উপাদানগুলো হলো—অর্থনীতিতে GDP-র প্রবৃদ্ধির হার, বিনিয়োগের ধরন, সুদের হার, ট্যাক্স রেট ইত্যাদি। অবশ্য যাঁদের তত্ত্বীয় বিদ্যা কম কিন্তু শেয়ারবাজারে লেগে আছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি বা কমার ক্ষেত্রে এসব মানতে চান না। তাঁদের বুঝিয়ে বললে তাঁরা বলেন, এত বুঝে কেউ-ই শেয়ার কেনে না। প্রশ্ন হলো, তাহলে কী বুঝে শেয়ার কিনতে হবে? জুয়া খেলার ময়দানে অবশ্য তত্ত্বীয় জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই। তাঁদের সাফ কথা হলো, বেশি জানলে বেশি ক্ষতি! বেশি বোঝার লোকেরাই শেয়ারবাজারে খারাপ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে অনেক লাভকে অনেক বিনিয়োগকারীই প্রাধান্য দেন। এ অবস্থায় তাঁরা যে একটা Zero sum game বা ‘যোগফলশূন্য’ খেলায় মেতেছেন, তা কি বুঝতে পারেন?

হালে অনেক সম্পদ ব্যবস্থাপক নতুন নতুন ফান্ড নিয়ে বাজারে প্রবেশ করেছেন। জানি না, তাঁদের জন্য উপযুক্ত শেয়ার কয়টা আছে, যেগুলোতে বিনিয়োগ করে তাঁরাও যাঁদের থেকে অর্থ নিয়েছেন, তাঁদের একটা সম্মানজনক মুনাফা দিতে পারবেন।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়