মোস্তফা কামাল
খােলা বাজার২৪। বৃহস্পতিবার, ২ নভেম্বর, ২০১৭: নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনারদের সংলাপ শেষ হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার মো. নুরুল হুদার দু-একটি মন্তব্য নিয়ে রাজনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলেও সামগ্রিক বিচারে বলা যায়, সংলাপ অত্যন্ত সফল হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন সফল হবে তো?
নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা আছে! সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে? সরকার আবারও কি বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন করবে? নাকি সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে? বিদ্যমান পরিস্থিতি মানুষ স্বাভাবিক বলে মনে করছে না। তাদের ধারণা, রাজনীতিতে একধরনের গুমট ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থার কর্মকাণ্ড দেখে অনেকেই শঙ্কিত। এ পরিস্থিতিকে স্বস্তিদায়ক বলা যায় না।
আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব আশাবাদী মানুষ। খুব দ্রুত আশা হারাই না। একেবারে শেষ ক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাই। যদি টানেলের শেষ প্রান্তে এক বিন্দুও আলো দেখা যায়, সেই আলোটুকুকেই আশার প্রতীক হিসেবে মনে করি। যদিও বাঙালি চরিত্রই হচ্ছে দ্রুত আশাহত হওয়া এবং হতাশায় হাবুডুবু খাওয়া।
নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করাই যেন বাঙালির চিরায়ত স্বভাব। বঙ্গবন্ধু বলতেন, বাঙালি পরশ্রীকাতর। অন্যের ভালো দেখতে পারে না। কেউ যদি ওপরে ওঠে, তাকে কিভাবে নিচে নামানো যায় সে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। প্রয়োজনে নিজেই টেনে-হিঁচড়ে নামাতে এক মুহূর্তও দেরি করে না।
অনেক আশা নিয়ে নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে। সংলাপে সর্বমোট ৪০টি রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া দেশের সংবাদপত্র, টিভি মিডিয়া ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের কর্তাব্যক্তি, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা অংশ নেন। তাঁরা নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে শত শত প্রস্তাব দিয়েছেন। এতেই বোঝা যায়, নির্বাচন সফল করতে তাঁরা কতটা আন্তরিক।
প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আগামী নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে অনেকগুলো প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে সরকার কাঠামো, সেনা মোতায়েন ও সীমানা নির্ধারণ প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী অবস্থান রয়েছে। আমরা যদি এ ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য দিই, তাহলে পাঠকদের বুঝতে সুবিধা হবে।
বর্তমান সংসদ ভেঙে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপিসহ ২০টি রাজনৈতিক দল। আর বিপক্ষে মত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ৯টি রাজনৈতিক দল। বিএনপি মনে করে, বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন প্রভাবিত করবেন। নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। সংসদ ভেঙে দিতে হবে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপিকে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের কোনো কোনো নেতা বলছেন, বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন করবে। আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়ে যাবে। সংগত কারণেই বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। সরকারকে চাপে রেখে যতটুকু সুবিধা আদায় করতে পারে, সেটাই বিএনপির লাভ!
নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে সরকারের অন্যতম অংশীদার জাতীয় পার্টিসহ ২৩টি রাজনৈতিক দল। তারা বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে সেনা মোতায়েন করতে হবে।
ক্ষমতাসীন দলসহ ৯টি রাজনৈতিক দল সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে মত দিয়েছে। তারা বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই যথেষ্ট। সেনাবাহিনীর কোনো প্রয়োজন নেই। সীমানা নির্ধারণের ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বর্তমান সীমানায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। বিএনপি বলছে, ভোটারসংখ্যার ভিত্তিতে পরিবর্তন করতে হবে। অথবা ২০০৮ সালের আগের সীমানা পুনর্বহাল করতে হবে।
ইভিএমের পক্ষে ক্ষমতাসীন দল জোর তত্পরতা চালালেও বিএনপি এর বিপক্ষে। বিএনপি বলছে, এর ফলে ভোট কারসাজির সুযোগ তৈরি হবে।
সংলাপে যেসব ইস্যু উঠে এসেছে, এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেই মতবিরোধ আছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কী হবে, তা চূড়ান্ত করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নেই। তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধু পরামর্শ দিতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো সেই পরামর্শ মানতেও পারে। আবার না-ও মানতে পারে।
তবে ইস্যুটির সমাধান প্রয়োজন। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকেই সমাধান বের করতে হবে। ইতিমধ্যেই বিএনপি বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোকে জানিয়েছে। অতি সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকা সফরে এলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁকে বিষয়টি অবহিত করেন এবং সহযোগিতা কামনা করেন।
সুষমা স্বরাজ খালেদা জিয়াকে বলেন, ভারতেও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। সেখানে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। নির্বাচন কমিশনই সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করে। যে ব্যবস্থা ভারতে নেই, সে ব্যবস্থা বাংলাদেশে চালুর ব্যাপারে তিনি পরামর্শ দেন কী করে! তবে তিনি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন।
আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে বলা হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বরাবরই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে আসছে। আমেরিকার ভরসাও গণতান্ত্রিক সরকারের ওপর। ফলে অগণতান্ত্রিক কোনো ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন পাবে না। দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় পৌঁছতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক দলগুলো চাইলেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে পারে। আমরা নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন দেখেছি। রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতার কারণেই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হয়েছে। আগামী বছরের শুরুর দিকে ছয়টি সিটির নির্বাচন হবে। এই ছয় সিটির নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কেউ কেউ বলছেন, আসন্ন সিটি নির্বাচন ইসির জন্য এসিড টেস্ট। এতে সফল হলে ইসির ভাবমূর্তি বাড়বে এবং সাধারণ মানুষও আরো বেশি আশাবাদী হয়ে উঠবে।
অনেকেই অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার দুটি মন্তব্যে হতাশ হয়েছেন। বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসে সিইসি বলেছেন, জিয়াউর রহমানের আমলেই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি নিজের বিশ্বাস থেকেই এ কথা বলেছেন। পরে তিনি এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।
অনেকেই মনে করেন, বিএনপিকে খুশি করার কৌশল হিসেবে তিনি ওই মন্তব্য করেছেন। একইভাবে তিনি ক্ষমতাসীন দলকে খুশি করতে বলেছেন, ‘আমরা আপনাদের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করব। ’
এ ধরনের মন্তব্য অপরিপক্বতার পরিচয় বহন করে। সিইসি এ ধরনের মন্তব্য না করেও ভিন্ন কৌশল নিতে পারতেন। বিতর্কিত ইস্যু তুলে বাহবা নেওয়ার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই। সিইসিকে আরো বেশি কৌশলী হতে হবে। আরো বেশি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। তাঁকে সিইসি পদের মর্যাদা বুঝতে হবে।
কথিত আছে, ‘চেয়ার মানুষ তৈরি করে। ’ কিন্তু আমি মনে করি, ‘মানুষই চেয়ার তৈরি করে। ’ এ ক্ষেত্রে উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, ১৯৯১ সালে অস্থায়ী সরকারপ্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ কিংবা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে সবার গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। আবার বিচারপতি লতিফুর রহমানও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ছিলেন। তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের কারণে জাতির কাছে নিন্দিত হয়েছেন।
একইভাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মোহাম্মদ আবু হেনা, এ টি এম শামসুল হুদার মতো ব্যক্তি অত্যন্ত সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেন। আবার বিচারপতি আবদুল আজিজের মতো মানুষও ওই পদে ছিলেন। যাঁকে জনদাবির মুখে বিদায় নিতে হয়েছিল। কাজেই আমরা নির্বাচন কমিশনে আর কোনো আবদুল আজিজকে দেখতে চাই না।
সবাই এ কথা স্বীকার করবেন যে এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন যে দায়িত্ব পালন করেছে, তাতে তাকে সফল বলা যায়। সামনের দিনগুলো চ্যালেঞ্জের। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নির্বাচন কমিশনকে সফল হতে হবে। নির্বাচন কমিশন সফল হোক—এটা গণতন্ত্রকামী প্রতিটি মানুষই চায়।
গণমাধ্যম নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত। রাজনৈতিক দলগুলোকেও সহযোগিতা দিতে হবে। তা না হলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নির্বাচন সুষ্ঠু করা সম্ভব হবে না। দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবাইকে সহযোগিতা দিতে হবে। আর সবার সহযোগিতা যাতে পাওয়া যায়, সে জন্য নির্বাচন কমিশনকেও পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক