খােলা বাজার২৪।শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭:
মোস্তফা কামাল
আবিদ আহমেদ ও কামরুল আহসান দুই বন্ধু। ছোটবেলা থেকেই তাঁদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব।
একই সঙ্গে লেখাপড়া ও বেড়ে ওঠা। দুজনের পারিবারিক সম্পর্কও বেশ মজবুত। তাঁরা ছাত্রজীবনেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। কামরুল আওয়ামী লীগ আর আবিদ বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা।
রাজনৈতিক কারণে দুই পরিবারের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। আগে এ অবস্থা ছিল না। কয়েক বছর ধরে অবনতি ঘটতে ঘটতে সম্পর্কের পারদ একেবারে নিচে নেমে গেছে। বলা যায়, তাঁদের সম্পর্ক সুতায় আটকে আছে; যদিও তাঁদের ওঠাবসা ও চলাফেরা একসঙ্গে। একজন আরেকজনকে ছাড়া চলতে পারেন না।
যেকোনো কাজ করতে গেলে একজন আরেকজনের পরামর্শ নেন। আবার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যায়।
দুই বন্ধুর কাণ্ডকীর্তি দেখে অনেকেই মন্তব্য করেন, ওঁদের সম্পর্কটা বড় অদ্ভুত। এই মুহূর্তে হয়তো ঝগড়া করছেন, আবার পরমুহূর্তেই দেখা যায় হাসছেন, খেলছেন, গল্প করছেন।
দুই বন্ধুর বিরোধ জাতির জনককে নিয়ে। এ ছাড়া স্বাধীনতার ঘোষক এবং ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালন নিয়ে তাঁরা প্রায়ই তর্কে মেতে ওঠেন। কখনো কখনো বিএনপি-জামায়াতের আঁতাত নিয়েও তাঁদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয়। কালে কালে সেই ঝগড়াঝাঁটি প্রতিহিংসায় রূপ নিয়েছে। এখন একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কে কাকে কিভাবে ল্যাং মারবেন, তা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটান তাঁরা।
কামরুল রাজনৈতিক দল করলেও ঠিকাদারি পেশার সঙ্গে জড়িত। সরকারি দল করলে ঠিকাদারির কাজ পাওয়া সহজ। আবার কাজ না করেও টাকা তুলে নেওয়া যায়। তবে লোকে বলে না যে পচা শামুকে পা কাটে! কামরুলের সে রকম অবস্থাই হয়েছে। তিনি কয়েকটি প্রকল্পের কাজ না করেই বেশির ভাগ টাকা তুলে নেন। বিষয়টি আবিদ আহমেদ জানতে পেরে সাংবাদিকদের কাছে ফাঁস করে দেন। পরদিনই পত্রিকায় ফলাও করে কামরুল আহসানের বিরুদ্ধে রিপোর্ট ছাপা হয়।
পত্রিকার রিপোর্ট দেখে কামরুল আহসানের মাথা খারাপ অবস্থা। কে করল কাজটা, তা জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন তিনি। ছুটে যান পত্রিকা অফিসে। কিভাবে তারা জানতে পারল তা জানার জন্য খোঁজখবর করেন। অনেক ঘোরাঘুরির পর জানতে পারেন, আবিদ আহমেদই রিপোর্টারদের তথ্য দিয়েছেন।
এ কথা শোনার পর কামরুল আহসানের মাথায় আগুন ধরে যায়। তিনি আবিদ আহমেদকে শায়েস্তা করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। তিনি মনে মনে ভাবেন, আবিদকে এমন ফাঁসান ফাঁসাতে হবে, যাতে কোনো দিন আমার বিরুদ্ধে লাগতে না আসে!
কামরুল আহসান ক্ষমতাসীন দলের নেতা। তাই তাঁর সঙ্গে স্থানীয় থানা পুলিশের দহরম-মহরম। তিনি থানায় গেলেন। ওসি সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তাঁকে বললেন, ওসি সাহেব, একটা লোককে সাইজ করতে হবে। কিভাবে করবেন চিন্তা করেন। লোকটা কিন্তু কঠিন বিএনপি!
ওসি সাহেব বললেন, হুম! বিএনপি হলেই তো সাইজ করা সহজ। কিন্তু লোকটা কে?
আমাদের পাড়ার আবিদ আহমেদ।
সে না আপনার বন্ধু?
আরে রাখেন আমার বন্ধু! ভয়ংকর খারাপ লোক। ওকে সাইজ না করলে আমাকে বিপদে ফেলবে। কয়েক দিন আগে সে আমার বিরুদ্ধে পত্রিকায় রিপোর্ট করিয়েছে।
ভেবেচিন্তে বলেন। পরে আবার বন্ধুর জন্য তদবির করতে আসবেন না।
ভেবেচিন্তেই বলছি। তাকে শক্ত করে ধরেন।
তাহলে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দিই!
দেন। জেলটেল খেটে আসুক। জেল না খাটলে সোজা হবে না।
ঠিক আছে। আমি দেখছি। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
পরদিনই ওসি সাহেব পুলিশ পাঠালেন আবিদ আহমেদের বাড়িতে। সাতসকালে বাড়িতে পুলিশ দেখে বিস্মিত হন আবিদ। তিনি পুলিশকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনারা?
পুলিশ ইন্সপেক্টর সোহেল বললেন, আপনার বাড়ি সার্চ করতে হবে।
মানে!
আপনার বিরুদ্ধে থানায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। আমরা সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই এসেছি।
কিসের অভিযোগ? কার অভিযোগ?
কামরুল আহসান সাহেব অভিযোগ করেছেন। আপনার বাড়িতে নাকি অবৈধ অস্ত্র আছে।
কামরুল! বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠে আবিদ আহমেদের।
পুলিশ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল, জি।
পুলিশ হুড়মুড় করে বাড়িতে ঢুকে সার্চ করা শুরু করল। হঠাৎ খাটের নিচ থেকে একটি ব্যাগ বের করে বলল, অভিযোগ সত্য। এই যে অস্ত্র! আপনার বাসায় অস্ত্র পাওয়া গেছে। অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো।
আবিদ আহমেদ নিরুপায়। তিনি পুলিশের সঙ্গে থানায় চলে গেলেন। যেতে যেতে মোবাইল ফোনে কামরুল আহসানকে বললেন, এত বড় মিথ্যাচার না করলেও পারতি! একদিন তোকে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
কামরুল আহসান শুধু বললেন, বেশি বাড়াবাড়ি করছো না! এইবার জেলে পচো!
বন্ধুকে জেলে পাঠিয়ে ভীষণ খুশি কামরুল আহসান। ফোন রেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন। হাসতে হাসতে তিনি বাসার দিকে পা বাড়ান। হঠাৎ তাঁকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তা। তাঁদের দেখে ভড়কে যান কামরুল। ভয় আর বিস্ময়মিশ্রিত কণ্ঠে তিনি বলেন, কী ব্যাপার! আপনারা কারা?
আমরা দুদকের লোক।
দুদকের নাম শুনে কামরুল আহসান ভয়ে কুঁকড়ে যান। শুকনো গলায় বলেন, দুদকের লোক!
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক