খােলা বাজার২৪। রবিবার,৭ জানুয়ারি, ২০১৮: কয়েক বছর ধরেই ব্যাংকিং খাতে ঋণবাজারে মন্দা চলছে। বেসরকারি বিনিয়োগ কম হওয়ায় ঋণের চাহিদাও ছিল কম। সে কারণে ব্যাংকগুলোয় অলস টাকার পরিমাণ প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এ অবস্থার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগে গতি না পেলেও গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে হঠাৎ ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে। প্রতিমাসেই রেকর্ড পরিমাণ ঋণ বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো। কয়েকটি ব্যাংক সীমা লঙ্ঘন করেও ঋণ বিতরণ করেছে। এ কারণে দুটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ ব্যাপক হারে বাড়ছে। সর্বশেষ গত নভেম্বরে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৯ দশমিক ০৬ শতাংশ। অক্টোবরে ১৮ দশমিক ৬৩, সেপ্টেম্বরে ১৯ দশমিক ৪০, আগস্টে ১৯ দশমিক ৮৪ এবং জুলাইয়ে বেড়েছিল ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। জুনে ঋণবৃদ্ধির হার ছিল ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর আগে এই বৃদ্ধির হার আরও কম ছিল। মুদ্রানীতিতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। ইতোমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ হয়ে গেছে।
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে আমানতবৃদ্ধির হার কমে গেছে; কিন্তু ঋণবৃদ্ধির হার বাড়ছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত আমানত বেড়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ; অন্যদিকে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৭ শতাংশ। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে জমে থাকা অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ প্রতিমাসেই কমে যাচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের ৭০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করে, চলতি বছরে সেপ্টেম্বরে এই হার বেড়ে আমানতের ৭৪ শতাংশ বিতরণ করেছে। মোট হিসাবে ঋণ বিতরণের হার এখনো নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকলেও বেশ কয়েকটি ব্যাংক এই সীমা অতিক্রম করে ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে গেছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক সংগৃহীত আমানতের ৯০ এবং তার চেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে।
অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি হারে ঋণ বিতরণ করায় বেসরকারি খাতের ওয়ান এবং প্রিমিয়ার ব্যাংকের অর্থ ব্লক (জব্দ) করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া শরিয়াভিত্তিক বেশ কয়েকটি ব্যাংককে সতর্কও করা হয়েছে। ফারমার্স ব্যাংক এই সীমা লঙ্ঘন করে আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ করায় এখন বড় ধরনের তারল্য সংকটে পড়েছে। মাত্র ৫ হাজার টাকার চেকের বিনিময়ে গ্রাহককে টাকা দিতে পারছে না ব্যাংকটি।
ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণের হার বেশি বেড়ে যাওয়া এবং আমানত বাড়ার হার কমে যাওয়ার কারণে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে, যা ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য অশনি সংকট হয়ে আসতে পারে। কেননা আমানতের সুদের হার আশঙ্কাজনকভাবে কমার কারণে মানুষ ব্যাংকে অর্থ রাখতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এতে হঠাৎ করে আমানত বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী বলেন, অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ বাড়তে পারে। কিন্তু বর্তমানে ঋণ বিতরণ বেড়ে ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এতে ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। এ জন্য ঋণ আমানতের অনুপাত (এডিআর) কমানোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চিন্তাভাবনা করছে। আগামী মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, আমানতকারীদের স্বার্থ ও ব্যাংকের তারল্য পর্যাপ্ত রাখার স্বার্থে সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংগৃহীত আমানতের ৮০ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারে। অবশিষ্ট অর্থের মধ্যে নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা অনুপাত (এসএলআর) হিসাবে ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ জমা রাখতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। নগদ লেনদেন মেটানোর জন্যও কিছু অর্থ নিজেদের কাছে রাখতে হয়। তবে ঋণের চাহিদা অনেক বেশি হলে এবং ব্যাংকের সার্বিক আর্থিক সূচকগুলো ভালো থাকলে সাধারণ ব্যাংক সংগৃহীত আমানতের সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংক সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। এর বেশি বিতরণ করতে পারে না।
এদিকে হঠাৎ আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণে নড়েচড়ে বসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামীতে এটি ঠেকাতে ঋণ বিতরণে সীমা কমিয়ে আনা হচ্ছে। গত ৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ না করে সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। আমাদের সময়