রবিউল আলম – খােলা বাজার২৪। রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো ২১শে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি? বাঙ্গালির কন্ঠে সুমধুর সুরে মাতৃভাষায় এ গান যেন প্রাণে স্পন্দন এনে দেয়। লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, গীতিকার ও অমর কবি আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা এ গান ছাড়া ২১শে ফেব্রুয়ারি চিন্তা করা যায় না এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গাফফার চৌধুরীর লেখা এই গান বাজানো হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি পাওয়া গাফফার চৌধুরীর অমর কবিতা গানের সুরে বেজে চলছে এবং বাজবেও চিরকাল। বাঙ্গালির মনে ২১শে ফেব্রুয়ারি এমন একটি শিকর যা এখন বটবৃক্ষের আকার ধারন করেছে। ভাষার জন্য জীবন কি আর বিশ্বের অন্য কোন জাতি দিতে পেরেছে ? আমরা গর্বিত, আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মাহুতির জন্য ও আত্মদানের জন্য।
বাঙ্গালির বীরত্ব ৭১ সালে দেখেছে সারা বিশ্ব, স্বাধীনতা ঠেকাতে পারে নাই বিশ্বের অনেক মোড়লরা। ভাষার পবিত্রতা রক্ষায় ১৯৬৭-৬৮ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন বাঙ্গালির পায়ে কোন জুতা দেখি নাই, যদিও কোন পাকিস্তানি ভাবধারার মানুষ জুতা পায়ে রাস্তায় বের হয়ে থাকে। বাঙ্গালি বিচ্ছু বাহিনী জুতা খুলে তাদের গলায় পরিয়ে দিয়েছে, এরকম হাজার ঘটনার স্বাক্ষি আমি। ভাষা নিয়ে রং তামাশা করতে চেয়েছে অনেকেই, সফলকাম হয় নাই। শত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে বাঙ্গালি ভাষা, বাংলা ভাষার জন্য জীবন দানকারীরা আজ ইতিহাস, আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে এবং পালন করা হচ্ছে। ভাষা নিয়ে তামাশা করার লোক এখনো প্রশাসনের কোন না কোন জায়গায় লুকিয়ে আছে। গত ২৯শে জানুয়ারি দৈনিক আমাদের অর্থনীতি পত্রিকায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ডিএনসিসি’র এলাকায় যেসব প্রতিষ্ঠানের নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লেখা হয়নি তা নিজ উদ্যোগে অপসার করে ৭ দিনের মধ্যে বাংলায় লিখে প্রতিস্থাপন করার নির্দেশ প্রদান করেছেন।
এর চেয়ে ভালো উদ্যোগ আর কি হতে পারে। বিজ্ঞপ্তিতে মহামান্য হাইকোর্টের একটি নির্দেশিকা দেখানো হয়েছে, বাঙ্গালি হয়ে আমরা আনন্দিত, বাঙ্গালির ভাষা রক্ষা করার এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ না দিয়ে কি পারা যায়। কিন্তু অবাক লাগে তখনি, যখন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশেনের সম্পত্তি বিভাগের গণবিজ্ঞপ্তিগুলো ইংরেজিতে প্রকাশ করা বন্ধ হয় নাই। হাটবাজার, গুদারা ঘাট, রাস্তার উন্নয়নের বিজ্ঞপ্তিগুলো ইংরেজিতে প্রকাশিত হচ্ছে। নিজের কর্মসূচির পরিবর্তন না করে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার পরিবর্তন হবে কি। বাংলা, বাঙ্গালির ভাষা নিয়ে রং তামাশা করা বন্ধ করতে হবে। হৃদয়ের ভাষার জন্য মহামান্য আদালতের নির্দেশিকার প্রয়োজন হয় ভাবতে অবাক ও লজ্জা লাগে। প্রতিটি বাঙ্গালির ভাষা, ভাষার জন্য যে বাঙ্গালি জীবন দিতে পারে, সেই বাঙ্গালিকে বাংলায় সাইনবোর্ড ব্যবহার করতে হাইকোর্টের নির্দেশিকার প্রয়োজন, কর্পোরেশনের বিজ্ঞপ্তির দরকার হয়।
অথচ সেই কর্পোরেশন ইংরেজিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। হায়রে বাংলাদেশ, হায়রে বাঙ্গালি, আমরা কার কাছে অভিযোগ করবো। আমরা যারা ছাপোষা লেখক আছি, তারা একের পর এক লিখে চলেছি, ভাষাকে শুধু ফেব্রুয়ারির মাঝে আবদ্ধ না করে সারা বছর ভাষার চর্চা করতে হবে। বাংলা ভাষায় নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড সহ সকল স্থানে বাংলা চালু করতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া সরকারি বিজ্ঞপ্তি বাংলায় প্রকাশ করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে ইংরেজি ব্যবহারের ভুত কোন কোন সরকারি কর্মকর্তার কাধে এখনো চেপে আছে। প্রশাসনের গায়ে ইংরেজি ভুত রেখে সর্বস্তরে বাংলা চালু করা অসম্ভব। বাঙ্গালির প্রাণের ভাষা বাংলা, ফেব্রুয়ারি আসলেই বাংলা নিয়ে তোড়জোর শুরু হয়ে যায়।
এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশ্ব যখন বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে গ্রহণ করেছে, মর্যাদা দিয়েছে, সেখানে আমাদের মধ্যে কিছু নরপিশাচ কেন ভাষা নিয়ে রং তামাশা করবো ? কেন মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবো ? কেন সিটি কর্পোরেশনের জরিমানা গুনবো ? কর্পোরেশন কেন ইংরেজিতে গণপিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে ? ভাষা নিয়ে রং তামাশা করলে সবাইকে জবাবদিহিতায় আনতে হবে। ফেব্রুয়ারি হবে জবাবদিহিতার মাস, তা না হলে শুধু শুধু ভাষা নিয়ে চিৎকার চেচামেচি বন্ধ করুন।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতি