Thu. Mar 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪। শুক্রবার, ০৯ মার্চ, ২০১৮: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে জে-ইউনিটভুক্ত ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ) পোষ্য (ওয়ার্ড) কোটায় ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সেখানে পোষ্য কোটা পূরণ হওয়ার পরেও উপাচার্যের আদেশে একজন এবং ভর্তি উপকমিটির বিশেষ বিবেচনায় তিনজনকে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপাচার্য এম আবদুস সোবহানের বিশেষ সুপারিশে পোষ্য কোটায় আইবিএতে-সিট ফাঁকা না থাকলেও জোবায়ের জিহান নামের একজনকে ভর্তি করা হয়েছে। তার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের উপপ্রধান চিকিৎসক ও রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ফকির মো. আবু জাহিদ।

জোবায়ের বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত সি-ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ৩৩৫৪তম ও জে-ইউনিটভুক্ত আইবিএতে ৯৩৭ মেধা তালিকায় ছিলেন। পোষ্য কোটা থাকার পরেও তিনি আইবিএতে ভর্তির মেধাক্রমে আসতে পারেননি। তার আগেই ওই সিট পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও অনিয়ম করে তাকে ভর্তি করা হয়।

ভর্তির নিয়ম সম্পর্কে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ফয়জার রহমান বলেন, ‘যে যে ইউনিটে কোয়ালিফাই মার্কস পাবে না, সে সেখানে ভর্তির জন্য বিবেচিত হবে না।’ আগেই সিট পূরণ হওয়ার পরে বিশেষ আদেশে কাউকে নেওয়া যাবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না না, নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ তিনি আরও জানান, কোনো শিক্ষার্থীর একটি ইউনিটে ভর্তির যোগ্যতা থাকলেও সেই যোগ্যতা নিয়ে চান্স না পাওয়া কোনো ইউনিটে সে ভর্তি হতে পারবে না। এখানে কারও বিশেষভাবে সুযোগ দেওয়া বিষয় নেই।

জানা যায়, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. আখতার ফারুকের মাধ্যমে উপাচার্যের কাছে একটি লিখিত আবেদন করেন জোবায়ের জিহান। তিনি সেখানে উল্লেখ করেন, ‘আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সি (বিজ্ঞান অনুষদ), এফ (জীব ও ভূ-বিজ্ঞান), ও জে-ইউনিটের (আইবিএ) ভর্তি পরীক্ষায় যথাক্রমে ৪৪.১৩, ৪০.৮৫ ও ৫৯.৫০ (নম্বর) পেয়েছি। ইতোমধ্যে পোষ্য কোটায় বিজ্ঞান অনুষদে গণিত বিভাগে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু আমার ইচ্ছা আইবিএতে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করা। বিধান অনুযায়ী এক অনুষদ থেকে আরেক অনুষদে ১০০০ টাকা ফি প্রদান করে অনুষদ পরিবর্তন করা যায়। ওই বিধানের আলোকে আমি সি-ইউনিট থেকে জে-ইউনিটে ভর্তি হতে ইচ্ছুক।’

ওই আবেদনটি ভর্তি উপকমিটিতে না তুলে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাক্ষর করেন ২৮ ডিসেম্বর। তিনি সেখানে বলেন, ‘ভর্তি করা হোক।’ ওই আবেদন পাওয়ার পরই আইবিএতে পোষ্য কোটায় সিট ফাঁকা না থাকলেও জোবায়ের জিহানকে সেখানে ভর্তি করার সুযোগ করে দেন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম।

তবে জোবায়ের জিহান ওই আবেদনে গণিত বিভাগে ভর্তির কথা বললেও সি-ইউনিটের ডিন অধ্যাপক মো. আখতার ফারুক আইবিএর পরিচালকের কাছে পাঠানো চিঠিতে সে বিষয়টি উল্লেখ করেননি। তিনি সেখানে শুধু সি-ইউনিটে জোবায়েরের মেধাক্রম কত ছিল সেটি উল্লেখ করেন। ওই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে সি-ইউনিটে ভর্তিকৃত নিম্নলিখিত ১ জন ছাত্রের (জোবায়ের জিহান) কাগজপত্র সি-ইউনিট থেকে জে-ইউনিটে ভর্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আপনার নিকট প্রেরণ করা হলো।’

আইবিএতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জোবায়ের জিহানকে উপাচার্য বিশেষ ক্ষমতায় ভর্তি করালেও তার ওপরের মেধাতালিকায় থাকা অনেকেই ভর্তি থেকে বাদ পড়েছেন। অবাণিজ্য গ্রুপ থেকে জোবায়েরের প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৪৯ দশমিক ৫। সেই অনুযায়ী তিনি সেখানে পোষ্য কোটাতেও ভর্তির সুযোগ পাননি (তাই তিনি গণিতে ভর্তি হন)। কেননা তার ওপরে নম্বরধারী অন্তত সাতজন আছেন যারা আইবিএতে ভর্তির জন্য আবেদন করেও সুযোগ পাননি। তাদের প্রাপ্ত নম্বর হলো- ৫৬ দশমিক ৫, ৫৫ দশমিক ৫ (দুজন), ৫৪ দশমিক ৫, ৫৪ দশমিক ৫, ৫৩ দশমিক ৫ এবং ৫২ দশমিক ৫। এর বাইরে বাণিজ্য গ্রুপেও জোবায়েরের চেয়ে বেশি নম্বরধারী শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাননি।

আইবিএতে মেধাক্রম অনেক নিচে থাকার পরে এবং সিট ফাঁকা না থাকলেও কীভাবে ছেলেকে ভর্তি করালেন- এমন প্রশ্নের জবাবে জোবায়ের জিহানের বাবা ফকির মো. আবু জাহিদ বলেন, ‘বিধান অনুযায়ী তাকে (জোবায়ের) ভর্তি করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ’র পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভর্তির জন্য উপাচার্য আদেশ দেওয়ায় তাকে (জোবায়ের) ভর্তি করা হয়েছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট ডিনের মাধ্যমে চিঠি পাওয়ার পর সেখানে তাকে (জোবায়ের) ভর্তি করার জন্য বলেছি।’ তবে তিনি যদি ভর্তির যোগ্য না হয়ে থাকে তাহলে বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন উপাচার্য।

আইবিএ’র কোটা
জে-ইউনিটে এ বছরের ভর্তি পরীক্ষায় মোট সিট ছিল ৫০টি। এর বাইরে পোষ্য কোটা চারটি এবং মুক্তিযোদ্ধা, উপজাতি ও প্রতিবন্ধী কোটায় তিনটি করে সিট নির্ধারিত ছিল। তবে পোষ্য কোটায় এ বছর চারজন শিক্ষার্থীর বাইরে আরও চারজনকে বাড়তি ভর্তি করা হয়। তারা হলেন- আয়শা খাতুন, নিশাত তাসনিম সূচনা ও মো. রাজু আহমেদ। এ ছাড়া সি-ইউনিট থেকে জোবায়েরকে সেখানে পাঠানো হয়।

আইবিএতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পোষ্য কোটায় ভর্তির জন্য প্রয়োজন ছিল ১০০ এর মধ্যে মোট ৪০ নম্বর। ওই ইউনিটে এবারের ভর্তি পরীক্ষায় ৪০ নম্বরের ওপরে পেয়ে আইবিএতে ভর্তির জন্য বাণিজ্য থেকে ৫৪ জন ও অবাণিজ্য থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেন।

পরে আইবিএতে তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, তাদের মধ্যে মেধাতালিকার প্রথম থেকে বাণিজ্য শাখা ও অবাণিজ্য শাখায় দু’জন করে চারজন ভর্তির করার নিয়ম ছিল।

সেই অনুযায়ী পোষ্য কোটায় বাণিজ্য গ্রুপ থেকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হন মাসুম আহমেদ (প্রাপ্ত নম্বর ৭৭ ও সমন্বিত মেধাক্রম ৩২) এবং মো. সাকিব রহমা (প্রাপ্ত নম্বর ৬৬ ও সমন্বিত মেধাক্রম ২৭৪)। এ ছাড়া অবাণিজ্য গ্রুপ থেকে নাজিফা জাহিন (প্রাপ্ত নম্বর ৭৩ দশমিক ৫ ও সমন্বিত মেধাক্রম ৪৪) এবং মো. ওসমান গনি (প্রাপ্ত নম্বর ৬৩ দশমিক ৫ ও সমন্বিত মেধাক্রম ২৪০)। তাদের তালিকা প্রকাশ করা হয় গত বছরের ২৯ নভেম্বর। এরপর তারা সেখানে ভর্তি হন।

বিশেষ বিবেচনায় পোষ্য কোটায় ভর্তি
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ওই চারজনের বাইরে পোষ্য কোটায় আর কাউকে ভর্তি করার নিয়ম না থাকলেও বিশেষভাবে আরও তিনজনকে ভর্তি করা হয়। গত ২৫ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি উপকমিটির সভায় জে-ইউনিটে ’বিশেষ বিবেচনায়’ তাদের ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। তারা হলেন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সর্টার মো. নাসির আলীর মেয়ে নিশাত তাসনিম সূচনা (বাণিজ্য গ্রুপ থেকে প্রাপ্ত নম্বর ৫৮ দশমিক ৫ ও সমন্বিত মেধাক্রম ৭১১) ও তাপসী রাবেয়া হলের অফিস সহায়ক মো. আমির হোসেনের মেয়ে আয়শা খাতুন (বাণিজ্য গ্রুপ থেকে প্রাপ্ত নম্বর ৫৭ দশমিক ৫ ও সমন্বিত মেধাক্রম ৭৬৩) এবং পরিবহন দপ্তরের চালক মো. রহমত আলীর ছেলে রাজু আহমেদ (অবাণিজ্য গ্রুপ থেকে প্রাপ্ত নম্বর ৫৮ দশমিক ৫ ও সমন্বিত মেধাক্রম ৪৩৯)। তবে সূচনা ও আয়শার ওপরে বেশি নম্বর পাওয়া পোষ্য কোটাধারী আরও ছয়জন শিক্ষার্থী ছিলেন এবং রাজুর ওপরে আরও দুজন শিক্ষার্থী ছিলেন।

গত ২৮ জানুয়ারি বিশেষ বিবেচনায় অনুমতি পাওয়া তিন শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগ সংক্রান্ত একটি চিঠি আইবিএ’র পরিচালকের কাছে পাঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক শাখার রেজিস্ট্রার এ এইচ এম আসলাম হোসেন।

এ বিষয়ে এএইচএম আসলাম হোসেন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সভাপতিত্বে ভর্তি উপকমিটি সিদ্ধান্তে সর্বোচ্চ মেধাক্রম অনুযায়ী ওই তিনজনকে আইবিএতে বিশেষ বিবেচনায় ভর্তির অনুমদোন দেওয়া হয়েছে।’ তবে বিশেষ বিবেচনায় শুধু তিনজনকে কেন ভর্তি করার অনুমোদন দেওয়া হলো সে বিষয়ে কোনো উত্তর দিতে পারেননি তিনি।

ভর্তি উপকমিটির ওই সভায় আইবিএ’র পরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইনস্টিটিউটটির অধ্যাপক মো. মোহসিন-উল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আইবিএতে পোষ্য কোটার চারটি সিট পূর্ণ হওয়ায় আমরা আর কাউকে নিতে চাইনি। কিন্তু ভর্তি উপকমিটির সভায় আমাদের ওপর তিনজন শিক্ষার্থীকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে কারণে তাদের তিনজনকে ভর্তি করানো হয়।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইবিএতে পোষ্য কোটায় পাশ নম্বর পেয়েও ভর্তির সুযোগ না পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ ভর্তির জন্য ১৫ জন আবেদন করেন। পরে সেখান থেকে সূচনা, আয়শা ও রাজুকে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়।

পোষ্য কোটা পূর্ণ হওয়ার পরেও কেন অন্যদের ভর্তি করা হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে আইবিএ’র পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি উপকমিটির সিদ্ধান্তে তাদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান বলেন, ‘আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই বিশেষ বিবেচনায় তিনজনকে ভর্তির অনুমতি দিয়েছে ভর্তি উপকমিটি।’ এ বিষয়ে তার একার কোনো মত নেই বলেও জানান তিনি। সূত্র : পরিবর্তন