Wed. Mar 12th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

আনিস আলমগীর – খােলা বাজার২৪। বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১৮ :  ত্রিপুরার নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ের পর সারা ভারতে মূর্তি ভাঙার ধুম লেগেছে। বিজেপি বাম বিরোধী মৌলবাদী শক্তি। তারা ত্রিপুরায় জিতে যাওয়ার পর ঘরে ঘরে গিয়ে সিপিএম নেতাকর্মীদের মেরেছে। সিপিএম-এর অফিস দখল করেছে আর বেলুনিয়ায় খুব জৌলুসের সঙ্গে বসানো লেলিনের মূর্তি উপড়ে ফেলেছে। তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে সারা ভারতব্যাপী। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম শক্তিশালী সংগঠন। কেরালায় এখনও তারা ক্ষমতায়।


পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য মূর্তি ভাঙার সংস্কৃতি দীর্ঘদিনের। ১৯৬৯/৭০ সালে চারু বাবুর নকশালবাড়ী বিপ্লবের কর্মীরা মোড়ে মোড়ে বসানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,রাজা রামমোহন রায়ের মতো পূজনীয় ব্যক্তিদের স্থাপিত মূর্তিগুলোর মাথা ভেঙে কনিষ্কের মূর্তির মতো করে রেখে যেত। তারা নাকি মনে করতো এরাই বিপ্লবকে বিঘ্নিত করেছে। এদের কারণেই বিপ্লব বিলম্বিত হচ্ছে। অথচ এরাই আদিম সমাজটাকে টেনে তুলে বিপ্লবীদের সম্মুখে উপস্থিত করেছেন। ত্রাতার ভূমিকায় এদের অবস্থানও গৌণ নয়।


এসব কারণে চারু বাবুদের বিপ্লব দীর্ঘজীবী হয়নি। ইতিহাসের প্রবহমান ধারাকে মেনে চলতে হয়। ত্রুটি উৎপাটন করার অধিকার আছে,ইতিহাস মুছে ফেলার অধিকার কারও নেই। বিজয়ের উল্লাসে এটা বিজেপির ঐতিহাসিক ত্রুটি। এখন না হোক, গতিপথে এর ফল বিজেপিকে ভোগ করতেই হবে।

ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবনাথ আরএসএস-এর ক্যাডার। সুদূর নাগপুরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি এক রক্ষণশীল চিন্তা লালন করেন। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে জোট করে ক্ষমতা পেয়ে রক্ষণশীল হলে চলবে না। দেবনাথ উদার হতে না পারলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে রাখা যাবে না। চরম ডানপন্থী আর চরম বামপন্থীরা কারও কথা শুনে না। কারণ, তারা মনে করে তাদের চেয়ে বেশি কেউ বুঝে না। তবু উপরের কথাটা বললাম– শুনেছি দেবনাথ নাকি বাংলাদেশের চাঁদপুরের ছেলে। তারা ত্রিপুরায় মোহাজের। মাটি আর রক্তের টানে কথাটা বলা।

খবরে এসেছে,ত্রিপুরায় মূর্তি ভাঙার প্রতিক্রিয়ায় বিজেপির পূর্বসূরী সংগঠন ভারতীয় জনতা সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির একটি আব মূর্তির মুখে কালি লাগানো ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ৭ মার্চ সকালে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় শ্যামা প্রসাদের মূর্তিটির ওপর হামলা হয়। ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচনের জয়ের পর উন্মত্ত বিজেপি সমর্থকেরা বেলুনিয়ায় রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের মূর্তি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে ভারতজুড়ে একের পর এক মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে, এটা তারই অংশ। শ্যামা প্রসাদের মূর্তিটির মুখমণ্ডলজুড়ে কালির পাশাপাশি চোখ ও কানের বেশিরভাগ অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাতুড়ি ব্যবহার করে মূর্তির এ অবস্থা করা হয় বলে ধারণা পুলিশের।

বিজেপি গিয়েছিলো শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির মূর্তি দুধ, গঙ্গাজল ঢেলে দিয়ে শুদ্ধ করতে। তারা সারা পশ্চিম বাংলায় এ কর্মসূচি দিয়েছে। কিন্তু কলকাতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ মূর্তিতে হাত দিতেও দেয়নি। লাঠিপেটা করে তাড়িয়েছে। সরকারের কথা হলো, এটা সিটি করপোরেশনের কাজ, তারা তা করে দেবে। তবে কোথাও কোথায় চুপি চুপি তারা ধোয়ার কাজ করছে।

শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করার পেছনে সিপিএম আছে বলে অভিযোগ বিজেপির। সিপিএম বলেছে তারা এ কাজ করেনি। ত্রিপুরায় যা ঘটেছে তাতে সিপিএম-এর থাকাটা অবিশ্বাস্য নয় কারও কাছে। কিন্তু তাদের না থাকার কথা বিশ্বাস করাও যায়। কারণ, তারা যখন পশ্চিম বাংলায় ক্ষমতায় ছিল তখন ১৯৮০ সালে কেওড়াতলা শ্মশানের পাশে একটা পার্কে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির এ মূর্তিটি বসিয়েছিলো। শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি সাম্প্রদায়িক ছিলেন সত্য। কিন্তু তিনি ও তার পিতা স্যার আশুতোষ মুখার্জির বিশেষ অবদান আছে বাঙালিদের জন্য।

১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহের সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব গরিমার পেছনে স্যার আশুতোষ মুখার্জির অবদান সবচেয়ে বেশি। তারা পিতা-পুত্র অশেষ পরিশ্রম করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার ব্যাপারে। উভয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও ছিলেন। প্রথম জীবনে স্যার আশুতোষ মুখার্জি ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি।

কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে কখনও নাক গলাতে পারেননি। কারণ,স্যার আশুতোষ মুখার্জি জানতেন এদের কারণে পতিতা হীরা বুলবুলির ছেলের অ্যাডমিসনের বিবাদ নিয়ে হিন্দু কলেজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এজন্য কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজ বলতেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্যার আশুতোষ মুখার্জি ও তার ছেলে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির জমিদারি, আর বিশ্বভারতী হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তার ছেলের জমিদারি।

বলছিলাম মূর্তির ব্যাপারে সিপিএম-এর কথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। কারণ,বামেরা যখন ক্ষমতায় তখন তারা ঘটা করে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছিল। তাহলে মূর্তি ভাঙতে গিয়ে মূর্তির মুখে কালি আর মূর্তির গায়ে চেনি মাস্তুল দিয়ে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করল কে? পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। তারা নাকি নকশাল কর্মী। জাদবপুর এলাকায় থাকে। তারা কি আদৌ নকশাল? না মূর্তি ভাঙার জন্য রাজনৈতিক দলের লোক নকশাল সেজেছে।

অনেকে বলছেন এ কাজ বিজেপির। তামিলনাড়ুর বিজেপি নেতা এইচ রাজা টুইট করে বলেছেন, লেলিনের পরে এখন রামস্বামী পেরিয়ার মূর্তি ভাঙা হবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রামস্বামী পেরিয়ার দলিত আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তামিলনাড়ু একসময়ে সারা ভারতে সুইপার মেথর সরবরাহ করতো। এদেরই নেতা ছিলেন তিনি। তার হাতেই ব্রাহ্মণবাদবিরোধী আন্দোলন পূর্ণতা পেয়েছিল।

তামিলনাড়ুর ভেলোরে পেরিয়ারের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে দু’জন লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ বলছে তারা মদ্যপ মাতাল। ডিএমকে জোরালো প্রতিবাদ করেছে। মিটিং মিছিল করে তারা তামিলনাড়ুতে উত্তাপ সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন স্থানে বিজেপি অফিস লক্ষ্য করে পেট্রোলবোমা ছোড়া হয়েছে।

মিরাটে অম্বেদকরের মূর্তি ভাঙাকে কেন্দ্র করে বহুজন সমাজ পার্টির কর্মীরা হাইওয়ে অবরোধ করেছে। মহারাষ্ট্রেও নাকি অম্বেদকরের মূর্তি ভেঙেছে। অম্বেদকরও দলিত নেতা। ভালো ছাত্র ছিলেন, সম্ভবত কাথিয়ারের মহারাজের অনুগ্রহ পেয়ে ব্যারিস্টারি পড়েছিলেন। তিনি স্বাধীন ভারতের নেহরু মন্ত্রিসভার আইনমন্ত্রী ছিলেন এবং শাসনতন্ত্র রচনা পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন।

অম্বেদকর শেষ বয়সে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন না হিন্দু ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণা হয়ে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন,তা আমি জানি না। দলিতদের নিয়ে গান্ধীর মাতামাতিকে তিনি বিদ্রুপ করতেন। এমনকি গান্ধীর কর্মকাণ্ডকে ভণ্ডামি বলতেও দ্বিধা করতেন না। গান্ধী আমরণ দলিতদের নিয়ে ছিলেন। তিনি দিল্লির দাঙ্গর মহল্লায় রাতযাপনও করেছেন। অথচ আম্বেদকর নিজ গোষ্ঠীর সঙ্গে না থেকে তাদের পরিত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কোনটা সঠিক ভণ্ডামি তা নির্ণয় করা মুশকিল।

মহান ব্যক্তিদের কর্মকে, বার্তাকে যুগ যুগ ধরে সচল,সবাক রাখার জন্য মূর্তি গড়া হয়। এর বাইরে মূর্তি গড়ার আর কোনও অভিব্যক্তি নেই। এ নিরীহ অভিব্যক্তিকে অপমান করা সঠিক হচ্ছে না।

লেখক: সাংবাদিক
[email protected]
বাংলাট্রিবিউন