খোলাবাজার২৪ঃ শনিবার ১৯মে, ২০১৮ঃ আমার জন্ম নোয়াখালী জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম চারুরিয়াতে। এটি নোয়াখালী জেলার সদর দপ্তর থেকে আনুমানিক ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি একটি গরিব জনপদ। এ গ্রামের প্রায় সব পরিবার একাধিকবার মেঘনার ভাঙনে তাদের সহায়-সম্পদ হারিয়ে অবশেষে এ গ্রামে এসে বসত গেড়েছে। গ্রামের অবস্থান মেঘনা নদী থেকে নিরাপদ দূরে বিধায় ধরে নেওয়া হয়েছিল যে তাদের আবার নতুন করে নদীর ভাঙনে পড়তে হবে না। আমার দাদা-বাবা ঘরদোর বানিয়ে স্থায়ীভাবে এখানে বসবাস শুরু করেন। পুকুর-জমি নিয়ে আমাদের বাড়ির আকার মোটামুটি বড় ছিল। ছোট বয়সে এর পুকুরে সাঁতার কেটে, এর জঙ্গলে ও মাঠে ঘোরাফেরা করে অনেক সময় কাটিয়েছি। আমাদের পুকুরে অন্য বাড়ির লোকজনও গোসল করত। কারণ সবার বাড়িতে পুকুর ছিল না।
আমার দাদা মৌলভি ছিলেন। শুনেছি, তিনি বরিশালে মাদরাসা-মক্তবে চাকরি করতেন। আমি অবশ্য তাঁকে পুরো সময় বাড়িতে দেখেছি। মনে হয় তিনি অবসরে গিয়েছিলেন। দাদিকে দেখিনি। তিনি আগেই প্রয়াত হয়েছিলেন। বাবারা দুই ভাই। দুজনই ম্যাট্রিক পাস করে আরো কিছু পড়াশোনা করেছেন। বাবা আইন পেশার (মোক্তারির) সনদ লাভ করেছিলেন, চাচা স্টেনোগ্রাফি শিখেছিলেন। সেই সুবাদে পাকিস্তানের রাজধানী করাচি ও ইসলামাবাদে চাকরি করেছেন। যেহেতু দুই ছেলেকেই ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাস করাতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় যে দাদা গ্রামপর্যায়ে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। বাবার অবস্থা আরো একটু ভালো ছিল; তিনি নোয়াখালী সদর, মাইজদী কোর্টে সরকারি প্লট বরাদ্দ পেয়ে সেই প্লটে বাসা তৈরি করেছিলেন।
গ্রামে আমি পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলাম। গ্রামের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে পড়াশোনা করেছি বলে মনে পড়ে না। বাড়িতে পড়াশোনা ভালো হবে না মনে করে বাবা আমাকে শহরের বাসায় নিয়ে আসেন। আমার বড় ভাইকে আগেই শহরের বাসায় নিয়ে আসা হয়েছিল। মা আমার ছোট ভাই ও এক বোনকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। আমাকে শহরের একটি বেসরকারি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হলো। বার্ষিক পরীক্ষার ফল ভালো হওয়ায় আমি দ্বিতীয় শ্রেণি টপকে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে প্রমোশন পেলাম। বড় ভাই তখন নোয়াখালী জিলা স্কুলের ছাত্র। বছরখানেক পরে মা আমার ভাই-বোনকে নিয়ে শহরের বাসায় উঠে এলেন। আমরা পুরোপুরি নোয়াখালী শহর লইয়ার্স কলোনির বাসিন্দা হয়ে গেলাম। গ্রামের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নিবিড় ছিল। মা বছরে এক-দুইবার গেলেও আমরা ভাই-বোনরা মাস-দুই মাসে একবার গ্রামের বাড়ি যেতাম। বাড়ির বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম, গাছ থেকে নারিকেল ও অন্যান্য ফল পেড়ে শহরের বাসায় নিয়ে যেতাম, পুকুর থেকে মাছ ধরতে চেষ্টা করতাম। দু-এক সময়ে সফল হতাম, তবে এর জন্য পারদর্শী আত্মীয়স্বজনের সহায়তার প্রয়োজন হতো। সে সহায়তা সব সময় পাওয়া যেত না। কোনো দিন বাড়িতে থেকে গেলে রাতে আমরা আমাদের ঘরেই ঘুমাতাম। বেশির ভাগ সময়ে আমরা দিনে দিনেই শহরে চলে আসতাম। বাড়ি থেকে ফসল বা ফলমূল পেতাম না বললেই চলে। আমরা মজা পেতাম যে এটি আমাদের বাড়ি। এর মাছ, ফলমূল আমাদেরই। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমার নিকটাত্মীয়, যারা পাশের বাড়িতে বসবাস করত, তাদের কাছে বাড়িটি বিক্রি করে দিয়েছি। বাড়িটি এখনো তাদের মালিকানায় আছে। মা-বাবা, দাদা-দাদির কবর পারিবারিক কবরস্থান হিসেবে রয়ে গেছে। বাড়ি গেলে পারিবারিক কবরস্থানের পাশে দাঁড়িয়ে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করতে ভুল করি না।
মাইজদী শহরের লইয়ার্স কলোনির বাসা থেকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে অনেক কাঁচা-পাকা রাস্তা পেরোতে হতো। কখনো রিকশায়, কখনো সাইকেলে অথবা কখনো হেঁটে এ পথ অতিক্রম করতাম। রাস্তার কিছু অংশ কাদাপানিতে ভর্তি থাকত। সে অংশে খুব সাবধানে পায়ের স্যান্ডেল হাতে নিয়ে, পায়জামা বা লুঙ্গি উঁচুতে তুলে হেঁটে পেরোতাম। তবু কাপড় ভিজে যেত, পায়ে কাদা লেগে থাকত। আশির দশক থেকে ধীরে ধীরে এ অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। অল্প অল্প করে রাস্তার বিভিন্ন অংশ পাকা হতে থাকে। নব্বইয়ের শেষে এসে প্রায় পুরো রাস্তা পাকা হয়ে যায়, যদিও আমাদের গ্রামের অংশ নিতান্তই সরু থাকে। তখন থেকে আমরা গাড়ি নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে পারছি। আমাদের পারিবারিক কবরস্থান ও এর পাশের রাস্তা পাকা হওয়ায় তখন থেকে পাকা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে কবর জিয়ারত করতে পারছি। কবরের পাশে বাড়ির মসজিদও পাকা ও উন্নত হয়েছে। আমাদের বাড়ির লোকজন এর ব্যবস্থাপনায় রয়েছে। সবার চেষ্টায় দিন দিন মসজিদের আরো উন্নতি হচ্ছে।
মসজিদের ইতিহাস মনে করতে গিয়ে এলাকার সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিবর্তনের ধারা এসে পড়ল। আমাদের গ্রামটি খুব দরিদ্র এলাকায় অবস্থিত। আগেই বলেছি, এখানকার প্রায় সব পরিবার নদীভাঙনের কবলে একাধিকবার পড়েছিল। এদের সহায়-সম্বল বেশি কিছু ছিল না। জোতজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। শ্রম আর মেধা নিয়েই তারা নতুন করে জীবন শুরু করেছিল। তিন-চারটি পরিবার ছাড়া গ্রামে সচ্ছল পরিবার ছিল না। আমাদের পরিবার এবং পাশের বাড়ির একটি পরিবার শিক্ষিত ছিল। তবে আমাদের বাড়ির হাফেজ ভাইয়েরা সবচেয়ে বেশি সচ্ছল ছিলেন। দেশের সর্বদক্ষিণ রেলওয়ে স্টেশন সোনাপুরে হাফেজ ভাইয়ের কাপড়ের দোকান ছিল। তাঁর দুই ছোট ভাই শাহ আলম ও খুরশিদ ভাই মোটামুটি শিক্ষিত ছিলেন। খুরশিদ ভাই ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। শাহ আলম ভাই অন্যত্র বাস করতেন। তাঁর ছেলে-মেয়েরা শিক্ষিত হয়েছিল। শাহ আলম ভাই এ বাড়িতে একটি ঘর বানিয়েছিলেন; কিন্তু এখানে থাকতেন না। মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব হাফেজ ভাইদের পরিবারের ওপর ছিল। হাফেজ ভাই, খুরশিদ ভাই, শাহ আলম ভাই মারা গিয়েছেন। বাড়িতে জৌলুসও আগের মতো নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় সবার অবস্থা ভালো হয়েছে। অথচ হাফেজ ভাইয়ের পরিবারের সচ্ছলতা কমে গেছে। বাড়ির ভেতরে গিয়ে মনে হলো বাড়িটি আগের তুলনায় শ্রীহীন হয়ে পড়েছে। গ্রামে অন্যদের অবস্থাও তেমন ভালো হয়েছে বলে মনে হয়নি। চোখ ঝলসানো কোনো ভবন দেখতে পাইনি। গ্রামের সাধারণ মানুষের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। এরা এখনো শ্রমজীবী অথবা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিম্নপর্যায়ের কর্মচারী। যেসব পরিবারের দু-একজন বিদেশে গেছে তাদের অবস্থা ভালো হচ্ছে বলে জেনেছি। তবে এখনো দৃশ্যমান হয়নি। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম আমাদের সমসাময়িক বা পাঁচ-দশ বছরের ছোট আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন কেউ বেঁচে নেই। এমনকি পরবর্তী প্রজন্মেরও অনেকে প্রয়াত হয়েছে। আশপাশের লোকের অবস্থা আগে বুঝতে পারিনি। মনে হয়েছে এ গ্রামে ৬০-৬৫ বছরের বেশি কেউ বাঁচে না। এদের গড় আয়ু জাতীয় মানের তুলনায় অনেক কম। তৃণমূল পর্যায়ে অন্যান্য গ্রাম থেকে আয়ুষ্কালসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ উপযোগী হবে।
শহর থেকে গ্রামে এবং চরাঞ্চলে যাওয়ার পথে রাস্তাঘাট ও বাড়িঘরের বড় রকমের উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়নি। চরের পথে গাছপালা আগের তুলনায় বড় হয়েছে। গাছ কেটে কয়েক জায়গায় কাঠের গুঁড়ি হিসেবে জমা করে রাখা হয়েছে। বোধ হয় এগুলো বেচাকেনা হয়। যেটি চোখে পড়েছে তা হচ্ছে দোকানপাটের সংখ্যা বৃদ্ধি। আগে যেখানে দু-একটি দোকান দেখেছি, সেখানে এখন ২০-৩০টি দোকান হয়ে গেছে। চরে যাওয়ার পথে ‘গুল-গুইল্লার’ বাজারে একটি বা দুটি চায়ের দোকান ছিল। এসব দোকানে আটা-ময়দার সঙ্গে চিনি বা গুড় গুলে গোল্লা বানিয়ে তেলে ভাজা হতো। এটি ছিল সস্তা দামের ‘গুল-গুইল্লা’। গ্রাহকরা এটি পছন্দ করে চায়ের সঙ্গে খেত। এখন সেখানে চায়ের দোকান ছাড়া আরো অনেক দোকান উঠেছে। নাশতার তালিকায় বৈচিত্র্য এসেছে। সোনাপুর বাজারে সার বেঁধে এক ডজনের বেশি ফলের দোকান সাজানো হয়েছে। দোকানে আঙুর, মালটা, আপেল, ডালিম, নাশপাতি শোভা পাচ্ছে। ক্রেতা খুব দেখিনি, তবে নিশ্চয়ই দিনের কোনো সময়ে ক্রেতার সমাগম হয়। নইলে এত দোকান চলে কিভাবে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, রেমিট্যান্সভোগীরা ফলের মূল ক্রেতা। যাদের বিদেশে অবস্থানকারী আপনজন বা আত্মীয়স্বজন রয়েছে, তারাই এখন সচ্ছল পরিবার। বিদেশ থেকে টাকা আসছে, তারা আরাম-আয়েশে থাকছে, দেদার খরচ করছে। যাদের বিদেশে কেউ নেই তাদের অবস্থা তত ভালো নয়। আগের মতোই আছে।
নোয়াখালী শহরে লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়েছে। ছোট বয়সে আমি যখন নোয়াখালীতে ছিলাম তখন শহরে বিদ্যুৎ ছিল না। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ছুটির সময়টা নোয়াখালী শহরে আমাদের আবাসস্থল লইয়ার্স কলোনিতে কাটাতাম। হারিকেন জ্বালিয়ে রাতে পড়াশোনা করতাম। সামনের পুকুরে গোসল করতাম। মা রসুইঘরে চেলা কাঠ দিয়ে রান্নাবান্না করতেন। এ ঘরেই মাদুর বিছিয়ে অথবা পিঁড়ি পেতে আমরা খাওয়াদাওয়া করেছি। আড্ডা জমাতাম। কোনো দিন কষ্ট অনুভব করিনি। কয়েকটি সরকারি অফিস ছাড়া শহরে পাকা ভবন ছিল না। নোয়াখালী সদর দপ্তর ১৯৪৮ সালে মাইজদীতে স্থানান্তরিত হলেও জেলার স্থায়ী সদর দপ্তর হিসেবে স্বীকৃতি পেতে এক যুগেরও বেশি সময় লেগে যায়। সে জন্য ষাটের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত শহরের বাসিন্দারা পাকা ভবন নির্মাণ করেনি। ষাটের দশকের শেষভাগে শহরে বিদ্যুৎ আসে। তখন থেকে ধীরে ধীরে ব্যক্তি খাতে পাকা ভবন নির্মাণ শুরু হয়। এখন শহরে অনেক পাকা ভবন নির্মিত হয়েছে। তবে উঁচু ভবন কিংবা সুরম্য অট্টালিকা বড় একটা চোখে পড়েনি। শহরতলিতে অন্য জেলার মতো বিপুলসংখ্যক পাকা ভবন এখনো নির্মিত হয়নি, যদিও বাড়িঘরের অবস্থা আগের থেকে কিছুটা ভালো হয়েছে। নোয়াখালীর লোকেরা দালানকোঠা নির্মাণের চেয়ে জোতজমি কিনতে বেশি আগ্রহী। এ কারণে শহরাঞ্চল, শহরতলি, এমনকি চরাঞ্চলেও জমির দাম অনেক বেড়ে গেছে। বাড়িঘরের জৌলুস তার তুলনায় বাড়েনি।
নোয়াখালী টাউন হলের চোখ ধাঁধানো উন্নতি হয়নি। এখন শিল্পকলা একাডেমি ও অন্যান্য ভবনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। টাউন হল দেখে হঠাৎ উপলব্ধি করলাম সময়ের অভিঘাতে মানুষের মনের কত পরিবর্তন ঘটে। স্কুলজীবনে, এমনকি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনেও মনের কোণে একটি ইচ্ছা জাগরূক ছিল যে কোনো একদিন শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে টাউন হলের মঞ্চে আমি বক্তৃতা করব। সবাই শুনবে। এটি হবে আমার জন্য এক বিরাট আনন্দ ও গর্বের ব্যাপার। কোথায়, কখন এই ইচ্ছাটি হারিয়ে গেছে তা বলতে পারব না। গত কয়েক দশকে একাধিকবার নোয়াখালী শহরে গিয়েছি। তবে একবারও টাউন হলে বক্তৃতা দেওয়ার ইচ্ছা হয়নি। তার বদলে জেলা প্রশাসকের কনফারেন্স হল কিংবা সার্কিট হাউসের সভাকক্ষে বক্তৃতা দিয়েই কাজ শেষ করেছি। সন্তুষ্ট থেকেছি। ছোট বয়সে ‘পাঠকের মৃত্যু’ গল্পটি পড়ে আনন্দ পেয়েছিলাম। বুঝলাম, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার কিশোর মনের মৃত্যু হয়েছে। জীবনের অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রাধিকার আমার কচি মনের অভিলাষকে চেপে মেরেছে।
এই লেখাটি নিয়ে এগোতে গিয়ে আমি মাঝেমধ্যে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছি। দু-একবার রীতিমতো শোকাতুর হয়ে পড়েছিলাম। শৈশবে, কৈশোরে, এমনকি যৌবনের বড় অংশে যাঁদের সান্নিধ্য-সাহচর্য পেয়েছি, যাঁদের স্নেহ-ভালোবাসা, আচার-আচরণের মাধুর্যে জীবনের অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাই আমাদের ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। এত আত্মীয় যে প্রয়াত হয়েছেন আগে তা এত তীব্রভাবে বুঝতে পারিনি। এ কয় দিন তাঁদের স্মৃতি এক গুমট মোহনীয়তায় আমার ওপর ভর করে আছে। এই স্মৃতি জীবনের অর্থই কেমন যেন ওলট-পালট করে দিচ্ছে। রীতিমতো কান্না পাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি আমরা একটা সময়ের জন্য, ধরে নেওয়া যাক ৬০, ৭০, ৮০ বছরের জন্য পৃথিবীতে আসি, নানাভাবে জীবন যাপন করি, তারপর চলে যাই। এর ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কিছু কাজকর্ম করি, সেসব নিয়ে বেঁচে থাকা লোকেরা কথাবার্তা বলে। প্রয়াত ব্যক্তি তাতে অংশগ্রহণকারী নয়, অংশীদারও নয়। উত্তরাধিকারীরা তাঁর সহায়-সম্পদ ভোগ করে, সেখানেও তাঁর কোনো অংশীদারি নেই, কোনো কথাবার্তাও নেই। যাঁরা চলে গেছেন তাঁরা অনন্তকালের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়কাল পৃথিবীর এক কোণে খেয়ে-পরে বেঁচেছিলেন, কাজকর্ম করেছেন, হাসি-কান্না, আনন্দ-উৎসবের অংশ হয়েছিলেন। এর বেশি তো আর কিছু নয়। তারপর অনন্তে মিশে গিয়েছিলেন। আমার শহরের, আমার গ্রামের প্রায় সব মুরব্বি বিদায় নিয়েছেন। তবে শহর-গ্রাম এখনো আছে; হয়তো শতসহস্র বছর ধরে টিকে থাকবে। চিরস্থায়ীও হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তবে মানুষ কেন সেরূপ হতে পারবে না?
লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান