Thu. Jul 3rd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলাবাজার২৪, শুক্রবার ,২৬ র্মাচ ২০২১ঃ ভোর বেলা মুয়াজ্জিন ফজরের আযান দেয়, নামাজের জন্য ডাকে। ধীরে ধীরে কালো আঁধার দূর হয়, পুব দিগন্তে সূর্য ওঠে। আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সোনালি রোদে ঝলমল করে প্রকৃতি। পাখি ডাকে, গাছে গাছে ফুল ফোটে। ফুলের সুগন্ধ ভাসে স্নিগ্ধ হাওয়ায়।
এমনই একটি অপরূপ সৌন্দর্য্যে ভরপুর একটি ছোট্ট গ্রাম। নাম তার রূপনগর। এ গ্রামেরই একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ গফুর আলী কৃষিকাজ করে সংসার চালায়। বাবা-মা নেই, ঘরে রয়েছে তার স্ত্রী রাবেয়া বেগম এবং তাদের মানিক, চোখের মণি, একমাত্র পুত্র আরমান। এদের নিয়েই গফুর আলীর সুখী পরিবার।
ভোর হলে লাঙল কাঁধে ছুটে যায় মাঠে, সারাদিন কাজ করে। যখন গোধূলী নামে,সন্ধ্যে হয়,তখন ফিরে আসে আপন আলয়। এরপরে চলে যায় হাতেম আলীর বাড়ি। হাতেম আলী এ গ্রামেরই একজন দানশীল,পরোপকারী, সৎ সমাজসেবক। গ্রামের সকলেই তাকে খুব শ্রদ্ধা করে তাকে ভালোবাসে। গ্রামের একমাত্র ব্যক্তি তিনি,যার বাড়িতে রেডিও আছে। তাই সন্ধ্যে হলে গ্রামের প্রায় মানুষ চলে আসে তার বাড়ি, দেশের বর্তমান অবস্থার রেডিওতে খবর শোনার জন্য। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর, দেশের অবস্থা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
প্রতিদিনের মতো গফুর আলী চলে যায় হাতেম আলীর বাড়ি, আজকের খবর শুনতে। সে শুনতে পায় দেশে নাকি মিলিটারি আসছে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি করছে, গ্রামে গ্রামে হত্যা, লুটপাট, ঘরবাড়ি পোড়ানো এমনকি মা-বোনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের সম্ভ্রম কেড়ে নিচ্ছে।
খবরে এসব যখন শোনে, গফুর আলীর মনে তখনই দেশের জন্য কিছু করার ইচ্ছে জাগে। সে শুনতে পায় রেডিওতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ৭ ই মার্চের ভাষণ শোনাচ্ছে। তিনি বলছেন :”তোমাদের যার যা আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকেবেলা ঝাঁপিয়ে পড়, তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম” তোমরা মনে রেখ,যতক্ষণ এ দেহে প্রাণ আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের শত্রুদের সাথে লড়তে হবে। ওদেরকে এ দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।
খবর শেষ হলে সকলের মুখে চিন্তার ছাপ আসে,কি হবে দেশের, কি হবে তাদের। এরপর হাতেম আলী এ বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেন গ্রামের পার্শ্ববর্তী লোকজনের সাথে। তিনি বলেন দেশে নাকি মুক্তিবাহিনী গঠন হবে, তাই সকলকে আহ্বান করছি। আমিও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিবো এবং আজ রাতেই রওনা হবো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য। যদি এই গ্রামের কেউ আমার সাথে যেতে চায়,তবে আজ রাতেই যেতে হবে।
এদিকে বাড়ি এসে গফুর আলী খেতে বসে। স্ত্রী রাবেয়া বেগম লক্ষ্য করলেন,তার স্বামীর চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন কি গো, তোমার কি হইছে? সেই কখন থেইক্কা দেখতাছি,তুমি অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবতাছো। তোমার কি হইছে আমারে খুইল্লা কও?
বৌ,আইজ খবরে শুনলাম দেশের অবস্থা খুব খারাপ, ঐ পাকসেনারা গেরামে গেরামে লুটপাট, ঘরবাড়ি আগুনে পোড়াইয়া ছাড়খাড় করতাছে,বৌ ওরা মানুষ নয়, ওরা পশু। ওদের কিছুতেই এই বাংলার মাটিতে থাকতে দেওন যাইবো না,ওদের এ দেশ ছাড়তে অইবো, ওরা আমাগো যেমন কইরা মারতাছে,ওদেরও তেমন কইরা মারতে অইবো। তাই ভাবতাছি আমিও যুদ্ধে যামু মুক্তিবাহিনীর লগে যোগ দিমু। হাতেম আলী ভাই আইজ যাইবো মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিব,আমিও তার লগে যামু।
কি কও তুমি??? তুমি গেলে আমাগো কে দেখবো, তোমার পোলারে কে দেখবো? :বৌ, তুই আমারে আর বাঁধা দিস না,আইজ যাইতে দেনা হইলে যে আমার মাতৃভূমির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা অইবো। আমি কি করে এই বাংলার মাটিকে কলঙ্কিত করতে দি? এ বাংলার মাটি আমার মা,আমি তার সন্তান, তাকে তো আমাকেই রক্ষা করতে হবে। রাবেয়া বেগম আর স্বামীকে আটকাতে পারলেন না।খাওয়া শেষে, ঘুমন্ত পুত্রের কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলেন রাতের আঁধারে।
মনে মনে তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি তার জীবন দিয়ে হলেও লড়াই করবেন,দেশকে স্বাধীন করবেন। আর যদি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বেঁচে থাকেন, তবে আবার ফিরে আসবেন তার এই সবুজ-শ্যামল গ্রামে। তিনি আবার লাঙল কাঁধে ছুটে যাবেন ফসলের মাঠে, প্রাণভরে উপভোগ করবেন কাঁচা মাটির সেই হৃদ জুড়ানো গন্ধ। তিনি সেদিন তার পরিবারকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে বাস করবেন। সেদিন দেশে থাকবে না মায়ের সন্তান হারা চিৎকার, ধর্ষিতা বোনের হাহাকার। সেদিন স্বাধীন দেশে উড়বে, একটি লাল সবুজের স্বাধীন পতাকা!