Sat. Jul 12th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খোলাবাজার অনলাইন ডেস্ক : ছেলের ছাগলকাণ্ডে টালমাটাল হয়ে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানের সাম্রাজ্য। মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আক্তার শিবলীর ঘরের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত কোরবানি উপলক্ষে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হন। এতেই বিপত্তি বাঁধে মতিউর রহমানের সংসার থেকে দীর্ঘ চাকরি জীবনের পড়ন্ত বেলার ক্যারিয়ারে। বেরিয়ে আসে মতিউরের দুই স্ত্রী ও সন্তানদের বিলাসী জীবনের গল্প।

গণমাধ্যমে উঠে আসে দুর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের ফিরিস্তি। ছেলের সম্পর্ক অস্বীকার করেও রেহাই মেলেনি তাতে। পরিচিত ও ঘনিষ্ঠজনদের বক্তব্য, সরকারি বিভিন্ন নথিপত্র স্পষ্ট করে দেয় মুশফিকুর রহমান ইফাত মতিউরেরই ছেলে। যতদূর জানা যায়, প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের পরামর্শে ছেলের সম্পর্ক অস্বীকার করেন মতিউর। তারা ধারণা করেন, এর মাধ্যমে তারা তাদের অবৈধ সম্পদের বিশাল সাম্রাজ্য আড়ালে রাখতে পারবেন। কিন্তু তা হয়নি। একের পর এক বেরিয়ে এসেছে মতিউর রহমানের দুর্নীতির সব খবর। স্ত্রী লায়লা কানিজও কলেজ শিক্ষক থেকে কীভাবে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। সে খবরও আড়ালে থাকেনি।

আড়ালে থাকেনি রাজধানীতে তাদের দুই ডজনের বেশি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, কানাডায় মেয়ে ফারজানা রহমান ইপসিতার কোটি টাকার বাড়ি, দামি গাড়ি, শেয়ার বাজারে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ, ঢাকা, গাজীপুর ও নরসিংদীতে কোটি কোটি টাকা মূল্যের জমি, পার্ক-রিসোর্টসহ আলিশান বাড়ির কোনো তথ্যই।

এদিকে থলের বিড়াল বের হতেই লাপাত্তা এনবিআরের সদস্য পদমর্যাদার সদ্য সাবেক এই কর্মকতা। চতুর্দিকে আলোচনা-সমালোচনা ও দুদকের অনুসন্ধান শুরু হওয়ার খবরের মধ্যেই লাপাত্তা হয়ে গেছেন মতিউর রহমান। ঈদের পর অফিস শুরু হলেও প্রথম দিন থেকেই তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত। লাপাত্তা হয়েছেন তার প্রথম স্ত্রী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লায়লা কানিজও। তিনিও অফিস করছেন না ঈদের পর থেকেই।

এদিকে গত রবিবার মতিউর রহমানকে এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে প্রত্যাহার করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। ওইদিনই দুর্নীতি দমন কমশিনের (দুদক) সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন জানান, মতিউরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এ বিষয়ে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে ‍দুর্নীতি দমন কমিশন। এই প্রেক্ষিতে দুদকের আবেদনের ভিত্তিতে মতিউরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন আদালত। একইসঙ্গে মতিউরের প্রথম স্ত্রী রায়পুরা উপজেলা চেয়ারম্যান লায়লা কানিজ ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের বিদেশযাত্রাও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

এ বিষয়ে গতকাল সোমবার দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন বলেন, ‘মতিউরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। মতিউরের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিতে অনুসন্ধান কর্মকর্তা আদালতে আবেদন করেছেন। আদালত থেকে মতিউরের বিদেশযাত্রার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মতিউর, তার স্ত্রী লায়লা কানিজ ও তাদের পুত্রসন্তান আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।’

আদালত কর্তৃক নিষেধাজ্ঞার খবরের মধ্যেই চাউর হয়েছে ইতোমধ্যেই দেশ ছেড়েছেন মতিউর। গতকাল দেশের দুটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, রবিবার বিকেলের দিকে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে মতিউর পালিয়ে গেছেন। তার ঘনিষ্ঠ একাধিক কাস্টমস কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন। খবরে বলা হয়, পালানোর সময় নিজেকে আড়াল করতে চুল ফেলে মাথা ন্যাড়া করেন মতিউর। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ছেলের ছাগলকাণ্ডে আলোচনায় আসার পর থেকেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অল্প সময়ে ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় তিনি আতঙ্কে ছিলেন। তার বিভিন্ন বাসভবনে খোঁজ নিয়েও সন্ধান মেলেনি।

এমনকি কোরবানির ঈদের ছুটির পর অফিস খুললেও তিনি আর অফিসে আসেননি। এই সময়ে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি দেশ ছাড়ার সব প্রস্তুতি সেরেছেন। তবে এরও আগে দেশ ছেড়েছেন ছাগলকাণ্ডের হোতা দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত। গত বুধবার মধ্যরাতে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর হয়ে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে উদ্দেশে মা শাম্মী আক্তার শিবলী ও ছোট ভাই ইরফানকে নিয়ে দেশ ছেড়েছেন ইফাত।

কোরবানির ঈদে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাদিক অ্যাগ্রো থেকে মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনে ভাইরাল হন। যদিও পরে অস্বীকার করা হয়। বলা হয় এক লাখ টাকা বায়না দিয়ে পরে ছাগলটি নেননি ইফাত। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে ছাগল কিনে নিজের বাসায় নিয়েছিলেন ইফাত। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর সমালোচনার জেরে পরে ছাগলটি ফেরত দিয়ে যান সাদিক অ্যাগ্রোতে।

এছাড়াও ঈদে ঢাকার বিভিন্ন খামার থেকে ইফাত ৭০ লাখ টাকার গরু কিনেছেন বলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমেও একের পর এক সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে মতিউর রহমানের ছেলের দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি, গাড়ি, আলিশান জীবনযাপন এবং মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে রিসোর্ট, শুটিং স্পট, বাংলোবাড়ি, জমিসহ নামে-বেনামে থাকা সম্পত্তি। শুরু হয় তুমুল আলোচনা-সমালোচনা।

মতিউর রহমান ছিলেন এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট। পাশাপাশি তিনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সরকার মনোনীত সদস্য ছিলেন। সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর গুরু দায়িত্বে থেকে তিনি নিজের সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন। আখের গুছিয়েছেন, স্ত্রী-সন্তান, শ্বশুর, শ্যালক, ভাই-ভাগ্নেসহ নিকটাত্মীয়দের।

দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত হওয়ার পর গত রবিবার সরকার তাকে বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের তার বর্তমান পদ থেকে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত (ওএসডি) করে। তবে কেন এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সরকারি প্রজ্ঞাপনে তা উল্লেখ করা হয়নি। বলা হয়েছে, ‘জনস্বার্থে জারিকৃত এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।’ এরপর গতকাল অর্থ মন্ত্রনালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে জারি করা এক নির্দেশনায় রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকেও তাকে অব্যহতি দেওয়া হয়।

নির্দেশনায় বলা হয়েছে, মো. মতিউর রহমানকে সোনালী ব্যাংক পিএলসির পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক পদ থেকে অপসারণের সুপারিশসহ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকীর কাছে এই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। মতিউর রহমান সোনালী ব্যাংকের সরকার মনোনীত পরিচালক ছিলেন। তবে অব্যহতির আগেই সোমবার অনুষ্ঠিত সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না তিনি।