খলিলুর রহমান খলিল, রংপুর প্রতিনিধি: রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র যেন দিন দিন আরও উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে। ওষুধ চুরির কেলেঙ্কারির পর এবার নতুন চাঞ্চল্যকর ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। হারবাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ও মালি হিসেবে নিয়োজিত গৌতম রায় নিজের নির্ধারিত দায়িত্ব ছেড়ে দীর্ঘদিন ধরে বহির্বিভাগের ওষুধ বিতরণ কক্ষে বসে রোগীদের মধ্যে এলোপ্যাথি ওষুধ সরবরাহ করছেন। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত ফার্মাসিস্ট নিয়মিত অবহেলা করে সময় কাটাচ্ছেন আড্ডায় কিংবা ব্যক্তিগত কাজে। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
গৌতম রায়ের পদবি ‘হারবাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (মালি)’। তার মূল দায়িত্ব ভেষজ গাছপালার পরিচর্যা এবং হারবাল ওষুধ বিতরণে সহায়তা করা। কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন ধরে বহির্বিভাগে বসে এলোপ্যাথি ওষুধ বিতরণ করছেন, যা তার যোগ্যতা ও দায়িত্বের বাইরে। অন্যদিকে, বহির্বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট নিয়মিত অফিসে উপস্থিত থাকলেও অধিকাংশ সময় মোবাইলে ব্যস্ত থাকেন বা চায়ের দোকানে আড্ডায় মগ্ন থাকেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয়রা আরও জানান, এই ফার্মাসিস্ট নিজেকে ‘ডাক্তার’ হিসেবে পরিচয় দেন এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ক্ষিপ্ত হয়ে হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, এলোপ্যাথি ওষুধ বিতরণের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা হলো ফার্মাসিস্টের ডিগ্রি বা সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ। অযোগ্য ব্যক্তির দ্বারা ওষুধ বিতরণের ফলে রোগীদের ভুল চিকিৎসা, অ্যালার্জি, বা গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এবং ড্রাগ অ্যাক্ট ১৯৪০ (সংশোধিত) অনুযায়ী, অযোগ্য ব্যক্তির দ্বারা ওষুধ বিতরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১৮ অনুসারে, এ ধরনের অনিয়ম প্রমাণিত হলে চাকরি থেকে বরখাস্ত, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, এমনকি মামলা পর্যন্ত হতে পারে।
তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হামদুল্লাহ’র যোগদানের পর থেকে হাসপাতালের পরিস্থিতি আরও ভয়ানক অবনতির দিকে গেছে। ওষুধ চুরি, অতিরিক্ত ফি আদায়, এবং কর্মীদের অপেশাদার আচরণের অভিযোগ এখন নিত্যদিনের ঘটনা। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কিছু কর্মী মাদক সেবন করে সাব-সেন্টারে বেহুঁশ অবস্থায় পড়ে থাকেন, এমনকি পুলিশের হস্তক্ষেপে তাদের উদ্ধার করতে হয়। সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে নির্ধারিত ৫০০ টাকা ফির পরিবর্তে ২-৩ গুণ বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে একটি সিন্ডিকেট রোগী ও তাদের পরিবারদের জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। রোগীরা অনেকেই অভিযোগ করেন, ড্রাইভার কখনও রশিদ প্রদান করেন না। রক্ত ও অন্যান্য টেস্ট করাতে গেলে পাওয়া যাচ্ছে না নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের। বদরগঞ্জ উপজেলায় বাড়ি হওয়ায় একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে প্রায়ই দেরিতে আসা ও দুপুর ২’টার আগেই প্রস্তানের সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া গিয়েছে।
সবচেয়ে বড় অভিযোগ কর্মরত ডাক্তারদের নিয়ে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হামদুল্লাহ’র কাছে ছুটি না নিয়ে নিজেই নিজের ছুটি ঘোষণা করছেন। এবং সে অনুযায়ী কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন। এই তালিকার শীর্ষে রয়েছেন গাইনি কনসালটেন্ট ডা. কেয়া রানি। কেয়া রানীর বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই। তিনি নিয়মিত অফিসে অনুপস্থিত থাকেন এবং স্বল্প সময় দিয়ে ব্যক্তিগত চেম্বারে চলে যান। এ নিয়ে রোগী ও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষোভের শেষ নেই।
সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হামদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, “কেউ যদি নিজের দায়িত্বে অবহেলা করে, তবে তার জবাবদিহি করতে হবে।” তবে তিনি এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেননি।
অন্যদিকে, আশার কথা জানিয়ে রংপুরের সিভিল সার্জন ডা. শাহীন সুলতানা আশ্বাস দিয়ে বলেন, “এসব গুরুতর অনিয়মের বিষয়গুলো আমাদের নজরে এসেছে। দ্রুত তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যাতে রোগীদের নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়।”
তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এই অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের ঘটনায় স্থানীয়রা হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তারা দ্রুত স্বচ্ছ তদন্ত এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টরে এ ধরনের অপেশাদার আচরণ শুধু রোগীদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে না, বরং জনগণের আস্থাও ক্ষুণ্ন করছে। সিভিল সার্জনের প্রতিশ্রুতির পর সবার দৃষ্টি এখন তদন্তের ফলাফল ও ব্যবস্থার দিকে। প্রশ্ন উঠছে— এই অনিয়মের জাল কি ভাঙা সম্ভব হবে, নাকি তারাগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আরও অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে?