খোলা বাজার২৪ ॥ সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫
ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ১৯৪২ সালে। বয়স তখন মাত্র ১৩। এর পর একে একে সাত দশক। হিন্দি ছবির প্লেব্যাকের জগতে এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী তিনি। নাম লতা মুঙ্গেশকার। ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জন্ম নেওয়া এই গুণী শিল্পীর আজ জন্মদিন। ৮৬ বছরে পা দিলেন তিনি।
নিজের এত লম্বা ক্যারিয়ারে হাজারখানেকের মতো চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন লতা। শুধু হিন্দিতে নয়, তিনি গান গেয়েছেন ৩৬টির বেশি আঞ্চলিক ভাষায়। তবে শুরুটা করেছিলেন হিন্দি ও মারাঠি ভাষার গান দিয়ে। পেয়েছেন ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ভারত-রতœ।
নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কখনোই তেমন একটা মুখ খোলেননি লতাজি। প্রায় এক মাসের চেষ্টার পর তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সাংবাদিক আফসানা আহমেদ।
২০১৩ সালের ২৮ জুলাই ভারতীয় দৈনিক পত্রিকা হিন্দুস্তান টাইমসে সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল, যেখানে নিজের জীবন এবং সংগীত সাধনা নিয়ে নানা বিষয়ে কথা বলেছিলেন লতা। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল প্রভু কুঞ্জের ফ্ল্যাটে।
প্রশ্ন : জীবনের অনেকটা তো পেরিয়ে এলেন। বয়স পৌঁছে গেল আশির কোটায়। জীবনটাকে কীভাবে দেখেন?
লতা : আমি সব সময়ই জীব্নটাকে ভালোবেসেছি। জীবনের সব উত্থান-পতন আমার জীবনকে পূর্ণ করেছে। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, বিভিন্ন ভূমিকা পালনের মাধ্যমে জীবনটাকে সুন্দরভাবে পার করতে পেরেছি। একজন কর্তব্যপরায়ণ কন্যা, ভাইবোনদের কাছে অভিভাবকসুলভ বড় বোন এবং আমার গানের ক্যারিয়ারে যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি। আমি সবক্ষেত্রে নিজের ভূমিকা ঠিকভাবে পালন করতে চেয়েছি। আমার ক্যারিয়ারের সপ্তম দশক চলছে এবং এখান থেকে দেখলে মনে হয়, জীবনটা আসলেই অনেক সুন্দর।
প্রশ্ন : সাধারণত আপনার বয়সে এসে মানুষ পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না। পরিবর্তনশীল সমাজ, চিন্তাভাবনা বা পরিবেশ কি আপনার ওপর কোনো প্রভাব ফেলেছে?
লতা : মানুষের উন্নয়নের জন্য যে পরিবর্তন, তাকে আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু আমাদের জীবনের পরিবর্তনগুলো আমি পছন্দ করি না। আমি ১৯৪৫ সালে মুম্বাইয়ে আসি। আমাকে আমার চারপাশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছে। আমি সব রকমের পরিবর্তন দেখেছি। আমরা ভোর ৪টায় স্বাধীনভাবে রাস্তায় বেরিয়ে চৌপাঠি থেকে ঘুরে আসতে পারতাম। ছিনতাই, হয়রানি বা গাড়ির নিচে চাপা পড়ার কোনো ভয় ছিল না। তখন রাস্তায় দুর্ঘটনা প্রায় ঘটত না বললেই চলে। আর আমাদের মধ্যে ভয়ের কোনো চিহ্নও তাই ছিল না। এখন এ ধরনের স্বাধীনতার কথা ভাবাই যায় না। এখন সবকিছুই আগের দিনের থেকে আলাদা এবং অদ্ভুতভাবে আলাদা।
প্রশ্ন : যশ, খ্যাতি এবং অর্থ—আপনার জীবনে এসবের মানে কী এখন?
লতা : এগুলো অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু ব্যাপারগুলোকে আমি একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখি। আমি একটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি এবং জীবনের প্রায় সব স্তর দেখেছি। আমি বলব, অর্থের ভূমিকা জীবনে ক্ষণস্থায়ী, তবে জীবনে টাকার একটা নিজস্ব অবস্থান রয়েছে। কিন্তু আপনি যখন মারা যাবেন, তখন আপনার নামটাই শুধু থেকে যাবে এবং আপনি যা করে গেছেন, সেগুলোই থাকবে। আমার অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধি থেকে বলতে পারি, যশ-খ্যাতি এলে টাকাও তার সঙ্গে আসে। কিন্তু নিজের পরিচিতি তৈরি করতে প্রচুর শ্রম দিতে হয়। অমানুষিক পরিশ্রমের পরই মানুষ আপনাকে গ্রহণ করবে। কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হবে—এটাই পৃথিবীর নিয়ম।
প্রশ্ন : আপনার আত্মত্যাগের ব্যাপারে বলবেন?
লতা : হিসাববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হিসাব খাটে, কিন্তু আত্মত্যাগের কোনো হিসাব থাকে না। আমি যা কিছু ত্যাগ করেছি, সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।
প্রশ্ন : আপনার সমসাময়িক যাঁরা ছিলেন, একে একে সবাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁদের অনুপস্থিতি কীভাবে অনুভব করেন?
লতা : যখন মানুষ মারা যায়, তখন একরকম অদ্ভুত শূন্যতা বিরাজ করে চারপাশে। কানাডায় আমার খুব কাছের এক বান্ধবী থাকত। কিছুদিন আগে ও মারা গেল। আমার সব বন্ধুই এখন ওপারে পাড়ি জমিয়েছে আর তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে সোনালি দিনগুলোও এখন অতীত। আমি এখনো ইয়াশজির (ইয়াশ চোপড়া) মৃত্যুর ধাক্কা সামলে উঠতে পারিনি। তিনি আমাকে ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করতেন। সেই সম্বোধন এখনো আমার কানে বাজে। সবকিছুই ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সেগুলো আমার হৃদয়ে থেকে যাবে। আমি তাঁদের মিস করব—তাঁদের সংগীত, তাঁদের সহযোগিতা। মদন ( মোহন) ভাইয়ের মতো সংগীত পরিচালক আমার প্রতিবেশী ছিলেন। সন্ধ্যায় আমরা অনেক আড্ডা দিতাম। হেমন্ত (কুমার) দাদা এবং এসডি বর্মনকেও খুব মিস করি। এসডি বর্মন আমাকে ‘বেটি’ বলে ডাকতেন। আরডি বর্মনের সঙ্গেও আমার খুব ভালো সখ্য ছিল। ও আমাকে ‘বোন’ বলে ডাকত।
প্রশ্ন : আপনি এখনকার ছবিতে গান করেন না কেন?
লতা : ছয় দশক ধরে আমি ছবিতে গান গেয়েছি। আমার মনে হয় না, আমার গলা এখন আর এই সময়ের ছবির সঙ্গে যায়। যে ধরনের গান তারা আজকাল করে, তা অনেকটাই দৃশ্যকেন্দ্রিক গান। এ ধরনের গান আমি গাইতে পারব না।
প্রশ্ন : গান মিস করেন না?
লতা : আমার নিজের মিউজিক কোম্পানি এলএম মিউজিকের জন্য গাই। অন্যান্য মিউজিক কোম্পানির মতো আমরাও সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইউটিউবের সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই করছি। কিন্তু এখন আমি খুব সময় দিচ্ছি প্রতিষ্ঠানটির পেছনে। নতুন গান রেকর্ড করছি। আমরা এখন পর্যন্ত ১৬টি রেকর্ড বের করেছি। সেগুলো ভালোই চলছে বাজারে।
প্রশ্ন : আপনি কি প্রকৃতিগতভাবেই একজন ধার্মিক মানুষ?
লতা : আমি একাত্মবাদে বিশ্বাসী এবং সেটা আমার স্রষ্টা। সব ধর্মের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। আমি চার্চে যাই, দরগা ও মন্দিরেও যাই। সব ধর্মই আমাদের একই নির্দেশনা দেয়। এর মধ্যে বিভাজন তৈরি করা হয় কেন, আমি বুঝি না। ধর্মের অপব্যবহারের নিন্দা করি আমি এবং এর ঘোর বিরোধী আমি। মানুষের জন্য এটাই সবচেয়ে খারাপ ভাগ্য নিয়ে আসে। কারণ, ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমেই সহিংসতা তৈরি হয়। এগুলো আমাকে খুব ব্যথিত করে। রাজনীতিবিদরা ধর্মের অপব্যবহারকারীদের শাস্তির ব্যাপারটা সব সময় পাশ কাটিয়ে যান।
প্রশ্ন : রাজনীতি নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
লতা : আমি একজন শিল্পী, যাঁর কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপও আমি বুঝি না। আমি এর সঙ্গে জড়াইনি, কারণ আমি রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ খুঁজে পাইনি। তাই এ বিষয়ে বেশি কিছু বলাটা ঠিক হবে না।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনি তো একজন সংসদ সদস্য ছিলেন। তাহলে রাজনীতির সঙ্গে আপনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন না কীভাবে?
লতা : আমি মাত্র ছয় বছরের জন্য সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এই ছয় বছরে আমি মাত্র ছয়বার সংসদে গিয়েছি। এবং আমি কখনো কাউকে কোনো প্রতিশ্র“তি দিইনি। রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে কোনো রাজনীতিবিদও আমার কাছে আসেননি। তাই রাজনীতি বিষয়ে আমার জ্ঞান খুব সামান্য।
প্রশ্ন : আপনার রাগের কথা তো সবারই জানা। আপনি কীভাবে নিজের রাগ সামলে রেখেছেন এখন পর্যন্ত?
লতা : আমার অল্পতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, কিন্তু আমি কখনো কারো সঙ্গে ঝগড়া করিনি। কাজ করতে গিয়ে সহশিল্পী এবং সংগীত পরিচালকদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে; কিন্তু কখনোই খুব সিরিয়াস কিছু ছিল না। আমি আমার রাগের একটা উদাহরণ দিতে পারি। সাধারণত স্টুডিওতে রেকর্ডিংয়ে ঢোকার আগে আমি জুতা বাইরে রেখে যাই। এটা গানের প্রতি আমার এক ধরনের সম্মান। কিন্তু যখন মেজাজ খারাপ থাকত, তখন দেখা যেত স্যান্ডেল নিয়েই স্টুডিওতে ঢুকে যেতাম। আর তাহলেই সবাই বুঝত যে আজকে আমার মেজাজ খারাপ। তাই সবাই সামলে থাকত। তবে এখন বয়স ও সময়ের সঙ্গে রাগটাও পড়ে গেছে।
প্রশ্ন : লম্বা বেণি এবং সাধারণ শাড়ি আপনার ট্রেডমার্ক হয়ে উঠেছে। ফ্যাশন কি আপনার কাছ থেকে সব সময় পালিয়ে থেকেছে? ফ্যাশন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে কি আপনার মধ্যে কোনো ভয় কাজ করেছে?
লতা : ফ্যাশন আমার কাছ থেকে পালিয়ে যায়নি, আমিই সেটা এড়িয়ে গেছি। আমি যদি চাইতাম, আমিও একজন ফ্যাশন করা সংগীতশিল্পী হতে পারতাম। কিন্তু মেকআপ দেওয়া, লিপস্টিক দেওয়া বা আঁটো পোশাক পরা—এগুলো কখনোই আমার ভালো লাগেনি। এবং ছোটবেলা থেকে আমি এভাবেই বড় হয়েছি। আমাদের পরিবারটি ছিল একদম গোঁড়া মহারাষ্ট্রীয় পরিবার। আমার মা নয় গজের শাড়ি পরতেন। আমার মনে আছে, যখন আমি কৈশোরে পা দিয়েছি, তখন একদিন একটা পাফ-স্লিভড ফ্রক কিনেছিলাম। বাবা সেটা দেখে ভীষণ বকাঝকা করলেন। আর তখন থেকেই আমি এসব বাদ দিয়েছি।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনার বোন আশা ভোঁসলে বেশ ফ্যাশন সচেতন!
লতা : আমি জানি। বিয়ের পর ফ্যাশনে ওর আগ্রহ বেড়েছে। এবং ওকে ভালো মানায়।
প্রশ্ন : গান ছাড়া আর কী বিষয়ে আপনার আগ্রহ আছে?
লতা : ছবি তুলতে এবং রান্না করতে খুব পছন্দ করি আমি। আমার তৈরি গাজরের হালুয়া ও পাসান্দা সবাই খুব পছন্দ করে। আমি নিজের রুমে থাকতে এবং রুমে বসে পড়তে পছন্দ করি। বইয়ের জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগৎ এবং আমি সে জগতে হারিয়ে যেতে চাই। যদিও ফটোগ্রাফি আমার নেশা, তবে ইদানীং ছবি তোলা কমিয়ে দিয়েছি। কারণ, ডিজিটাল ক্যামেরার কাজ আমি তেমন একটা বুঝি না। আর আমার পুরোনো সাদা-কালো ক্যামেরাটা তেমন ব্যবহার করা হয় না, তাই সেটা বেচে দিয়েছি।
প্রশ্ন : সাধারণত কোনো সাক্ষাৎকারে আপনি তেমন মন খুলে কথা বলেন না, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ব্যতিক্রম। তাই একটা প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারছি না। জানতে পারি কি, জীবনের কোন ভূমিকা পালন করতে আপনার সবচেয়ে ভালো লেগেছে আর আপনার জীবনে কোনো ব্যক্তি সৌভাগ্য বয়ে এনেছিলেন?
লতা : কিছু কিছু কথা আছে যেগুলো শুধু নিজেরই জানা উচিত এবং অন্যদের জানানো একদমই উচিত নয়।
প্রশ্ন : মানুষ বলে যে স্বামী-সন্তান-সংসার ছাড়া নারীদের জীবনের কোনো মানে নেই। আপনি কি এটা বিশ্বাস করেন?
লতা : মানুষ সব ধরনের বিষয় নিয়েই কথা বলবে। তাই তাদের এড়িয়ে যাওয়া শিখতে হবে। আর না হলে সুখী জীবনযাপন করা কারো পক্ষে সম্ভব হবে না। যেসব বিষয় হতাশা জাগায়, তা থেকে দূরে থাকাই ভালো। আমি সব সময় সেটাই করেছি। আমি আপনাদের নেওয়া একটা সাক্ষাৎকার পড়েছি। যেখানে আমির খানের স্ত্রী কিরণ রাও খুব সুন্দরভাবে বলেছেন, প্রথমে এটা গুরুত্বপূর্ণ নিজের জীবনের সুখ খুঁজে বের করা। এবং নিজেকে নিয়ে এক ধরনের পূর্ণতা অনুভব করা। এই বোধ নিজের মতো জাগ্রত না হলে সন্তান-সংসার কিছুই আপনাকে পূর্ণতা দিতে পারবে না।
প্রশ্ন : আপনার মনের কোণে কি কোনো অপূর্ণ ইচ্ছা এখনো রয়ে গেছে?
লতা : আপনার প্রশ্ন শুনে গালিবের একটা শায়েরি মনে পড়ে গেল। হাজারো খোয়াইশে অ্যাইসি, কি হার খোয়াইশ পে দাম নিকলে, বহোত নিকলে মেরে আরমান লেকিন ফির ভি কাম নিকলে। এই কবিতার মতই বলব যে, হয়তো লেখাপড়াটা শেষ করতে পারলে আরো ভালো লাগত। আমি জানি, সেটা আর কখনোই সম্ভব নয়। আর সে জন্যই আমাদের পরিবারের ছেলেমেয়েদের আগে লেখাপড়া করিয়েছি ঠিকমতো। তার পর তারা তাদের পেশা বেছে নিয়েছে। আমি কলেজজীবন খুব মিস করি। আমি লেখাপড়া করে অধ্যাপক হতে চেয়েছিলাম। এর বাইরেও ক্ল্যাসিকাল সংগীতে দীক্ষা নেওয়ার ইচ্ছা ছিল।