খোলা বাজার২৪ ॥ শুক্রবার, ০২ অক্টোবর ২০১৫
টমাস হায়ওয়ার্ড । একজন বিদেশী শিল্পি যিনি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে জানেন। তিনি জানেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে। বাংলাদেশের গানের প্রতি আগ্রহটা সেই ২০১২ সালেই। হঠাৎ ইউটিউবে প্রকাশিত দুইটি বাংলা গান চোখে পড়ে। একজন বিদেশীর গলায় বাংলা গান শুনে চোখ এবং কান দুটোই আটকে যায় সেই দৃশ্যে। এরপরই যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় টমাসের সাথে। খুঁজে বের করা হয় তার ফেইসবুক আইডি এবং তার ব্যান্ডদলকে। মেইল পাঠানো হয় আগ্রহের কথা জানিয়ে। টমাসও বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ দেখিয়ে মেইলের উত্তর দেন। এবং আগ্রহ প্রকাশ করেন আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতে। সেই আগ্রহ থেকেই তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তার নিজের সম্পর্কে, তার ব্যান্ড সম্পর্কে, বাংলাদেশ নিয়ে তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে।
প্রশ্ন পেয়ে হয়ত অনেকটা আবেগে আপ্লুত হয়ে পরেন টমাস। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে নিজের ফেলে আসা সুন্দর কিছু মুহূর্ত। মূলত টমাসের বন্ধু ছিল জীবন আহমেদ। যার কাছ থেকেই বাংলা গান শেখা। বাঙ্গালীদের কাছ থেকে দেখা। বাংলাদেশীদের প্রতি তার আছে অকৃত্রিম ভালবাসা যা পুরোটাই আবেগ মাখা।
তার কথার মাঝে একবার তিনি বলেই ফেলেন তিনি হয়ত পূর্ব জনমে বাঙ্গালী ছিলেন।
টমাস লাকি আখন্দের জনপ্রিয় একটি গান ‘আমায় ডেকোনা’ মুখস্থ করেন। এবং পরবর্তিতে তা গেয়ে ইউটিউবে আপলোড করেন। টমাস আমাদের জানান তার গান লাকি আখন্দ শ্যোসাল মিডিয়াতে শেয়ারও করেছে এবং বাংলাদেশে আসলে তার সাথে গান গাওয়ার ইচ্ছাও পোষন করেছে। টমাস এতে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছেন।
টমাস বাঙ্গালাদেশী খাবার খুব পছন্দ করেন। বন্ধু জীবন আহমেদের কাছ থেকেই তার রান্না শেখা। এখনও তিনি মাঝে মধ্যে নিজ হাতে বাঙালী খাবার রান্না করে খান।
টমাসের একটি ব্যান্ডদল ছিল, যার নাম ব্যান্ড ব্লু বেরি। তবে গত বছর ব্যান্ড দলটি ভেঙ্গে যায়। টমাস বেশ কয়েকটি বাংলা গান গাইতে পারেন। তার আগ্রহ আছে জীবনের সাথে বাংলাদেশে আসার।
ভিনদেশি এই যুবকের কন্ঠে বাংলাগান শুনে আমরাও আবেগে আপ্লুত। নিজ দেশে যখন হিন্দি গান বা অন্য কোন গান বাজে আর সেখানে একজন বিদেশি পরম মমতায় বাংলাদেশী গান শুনিয়ে নিজেই তৃপ্ত সেখানে আমাদের অনেকটাই লজ্জায় ফেলে দেয়।
টমাসের সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:
প্রশ্ন: আমাদের আপনার জন্ম ও শৈশব নিয়ে কিছু জানান?
উত্তর: আমি সময়ের পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। আমি ২৭ সে.মি. ছিলাম এবং আমার ওজন ছিল ১ কেজি ৪০০ গ্রাম। যার ফলে আমাকে ২ মাস পর্যন্ত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়। আমার মা আমাকে জন্মদানের সময় রোলিং স্টোনের অ্যাঞ্জি শুনছিলেন। আমি ফ্রান্সের ব্রেস্ট ফিনিশটারে জন্মগ্রহণ করি। আমরা এখানকে পৃথিবীর শেষ বলে সম্বোধন করি, কারণ এই স্থান ফ্রান্সের একেবারে শেষভাগে। আসলে ফরাসিদের মাঝে ফিনিশটারের অর্থ হল, ল্যাটিন ভাষায় এর অর্থ ভূমি এবং ব্রিটেনের ভাষায় এর অর্থ হল বিশ্বের শুরু। আমার ফ্রান্স ও ব্রিটেন উভয় দেশের জাতীয়তা রয়েছে। আমি অনেক বেশি সৌভাগ্যবান ছিলাম কারণ আমার শৈশবকাল আমার স্নেহময় মা-বাবা এবং বিশাল পরিবারের মাঝে কেটেছে। তারা যতটুকু সম্ভব আমাকে সকল জাদুঘরের দর্শন করিয়েছেন। আমার বয়স যখন ৩ বছর ছিল তখন আমি লন্ডনের জাতীয় জাদুঘরে যেয়ে একটি মাটিসের দেহ দেখে চিৎকার করে উঠি ‘সেখানে একটি মাটিস’। তখন গ্যালারীর বাকি সবাই আমার দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমি সর্বদিকে দৌঁড়াতে থাকি এবং বেশি আগ্রহ দেখাই। আমার ছোট বেলার সবকিছু মনে আছে। আমি একজন কিনেস্থেটিক ও অত্যন্ত উদ্বিগ্ন একজন শিশু ছিলাম যে কখনও ঘুমাতে চাইত না। আমি আমার মা-বাবাকে পাগল করে রাখতাম।
প্রশ্ন: আপনার গান গাওয়ার আগ্রহ কখন থেকে শুরু হয় এবং আপনার অনুপ্রেরণা কে?
উত্তর: আমার দাদা ডেনিশ ছিলেন আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। সে নিজে একজন মিউজিশিয়ান ছিলেন। সে গিটার, পিয়ানো এবং একরডিওন বাজাতেন। আমার শিশুকালে তিনি আমাকে ব্লুস এবং এল্ভিসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। আমার মনে হয় জিম মরিসনের ভিডিও এবং ডোরস দেখা ছিল আমার প্রথম আবিষ্কার। আমি চিন্তা করেছি আমি সেরকমই কোন কিছু করতে চাই। আমি ২০ বছর বয়সে আমার প্রথম কনসার্টের আয়োজন করি। আমি প্রথমবার ষ্টেজে উঠার সময় অনেক বেশি চিন্তায় ছিলাম। আমার ডান হাতে এক গ্লাস হুইস্কি ছিল এবং বাম হাতে ছিল সিগারেট। বারের একজন আমাকে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আপনি নিজেকে সার্জ গেইন্সবার্গ বা অন্য কিছু মনে করেন’- সে একজন ফ্রান্সের গায়ক জিম মরিসনের তুলনায় তার মঞ্চে উপস্থাপনা অন্যরকম। এরপর থেকে আমি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হই এবং মঞ্চে মনে হয় যেন আমি ঘরে গান গাইছি। আমার মনে হয় আমি সেখানেই নিজেকে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত মনে করি এবং অন্যরাও তা অনুভব করতে পারে।
প্রশ্ন: আমাদের আপনার ব্যান্ড ব্লুবেরি সম্পর্কে কিছু বলুন?
উত্তর: ব্লুবেরি আমার প্রথম ব্যান্ড ছিল। আমি যুক্তরাজ্যে ও ফ্রান্সে এই ব্যান্ডের সাথে ৫০০ এর মত কনসার্ট করেছি। ২০১০ সালে ‘ওভার এন্ড ওভার’ নামের একটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। আমরা আমাদের কিছু অনুসারি পেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত গত বছর আমাদের ব্যান্ড ভেঙ্গে যায় এবং আমরা লন্ডনে বসবাস শুরু করি। আমরা লন্ডনের পূর্বে শেষের দিকে কয়েকজন বসবাস শুরু করি এবং সপ্তাহে ২-৩ দিন ক্লাবে গান করি। এটা অনেক ভাল বছর ছিল কিন্তু আধ্যাত্মিক ছিল। আমি আমার আধ্যাত্মিক ভাই লোনান লি মারসিয়ারের সাথে এক বিছানায় ঘুমাতাম। তিনি একজন গিটার বাদক ছিলেন। আমাদের কোন টাকা ছিল না, আমরা অনেক কষ্টে ছিলাম। জীবনে সবসময় ভাল যায় না। এখন আমি মন্ট্রিয়ালে বসবাস করছি। আমি আমার প্রথম একক অ্যালবাম রেকর্ড করছি এবং ক্লাবেও গান করছি। আমি আরও একটি বিষয় আবিষ্কার করেছি যে আমি একজন অভিনেতাও। আমি প্রথমে পাউল ছোটেলের ‘কর্পস মর্ট’ নামের একটি শর্ট ফিল্ম করেছিলাম। আপনি আমাকে পরবর্তী মুনশিন শিল্পে প্রধান অভিনেতার চরিত্রে দেখতে পারেন। একটি টরেন্টো ভিত্তিক জাপানের বিখ্যাত প্রযোজক ডিজে এই সিনেমার প্রযোজনা করবেন। এই ক্লিপটি অনেক শর্ট ফিল্মের মত। কিন্তু এর গভীরে একটি কাহিনী রয়েছে। আমি এর জন্য অপেক্ষা করতে পারছি না। তরুণ দুইজন লেখক আমার জন্য দুই ধরণের চরিত্র নিয়ে লিখছেন। অর্থের জন্য সময় বেশি লাগছে কিন্তু তাদের মাঝে অনেক সংযম রয়েছে। মন্ট্রিয়াল একটি সৃজনশীল শহর, এখানে অনেক অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: আমরা ইউটিউবে আপনার কিছু বাংলা গান দেখেছি। আপনি কি আমাদের সেই কাহিনী শুনাবেন?
উত্তর: হ্যাঁ, আমরা যখন লন্ডনের শেষ সিমানায় বসবাস করতাম তখন আমাদের ফ্লাটে ৪ জন বাংলাদেশি ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিল জীবন। আমার জীবনের সাথে পরিচয় হয়। সে খুব ভাল ইংরেজি বলতে পারতেন না, কিন্তু তিনি খুব ভাল সুরকার ছিলেন। আমাদের মাঝে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়। সে আমাকে বাংলায় কিছু গান শিখায় এবং আপনাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু ধারণা দেন। আমরা বোহেমিয়ান জীবনধারায় চলতে থাকি এবং একে-অপরকে সাহায্য করতে থাকি। আমরা একই নৌকায় চলমান ছিলাম এবং একে-অপরের সাথে সংযুক্ত ছিলাম। আমরা যদি ব্লুবেরি ব্যান্ডের সাথে সপ্তাহে ২-৩ বার গান না গাইতাম তাহলে ঘরে বসে খেলতাম। আমি ‘আমায় ডেকোনা’ ও ‘শ্রাবনের মেঘ’ গানের কথাগুলো মুখস্ত করি। আমাদের করা ইউটিউব ভিডিও এর জন্য সাড়া পেয়ে আমরা উৎসাহিত হই। আমি বাংলাদেশিদের কাছ থেকে অনেক সুন্দর ও প্রেরণাদায়ক বার্তা পাই। লাকি আখন্দ আমাদের ভিডিও শেয়ার করেন এবং আমাদের বলেন আমরা যদি বাংলাদেশে আসি তাহলে সে আমাদের সাথে গান গাইবে। এরকম একজন লেজেন্ডের সাথে গান গাওয়া সত্যি অনেক আনন্দের হবে।
প্রশ্ন: আপনি কি বাংলাদেশের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমাদের সাথে শেয়ার করবেন?
উত্তর: জীবন আমাদের জন্য বাংলাদেশি খাবার রান্না করত। আমাদের কাছে এই খাবার অনেক ঝাল লাগত, ফলে খাবার পর আমাদের ঘাম বের হয়ে যেত কিন্তু খাবার অনেক ভাল ছিল। পরে আমাদের এসব খাবার অভ্যাস হয়ে যায়। সে ডাল খিচুরি, মুরগীর মাসালা, পরাটা, ইলিশ মাছ রান্না করতেন। প্রতিবার এটা খেতে উৎসবের মত মনে হত। আমরা মুসলমান না, কিন্তু আমরা প্লেটে সকল খাবার মিশিয়ে নিজ হাতে খেতে পছন্দ করি। তারা কিভাবে বসবাস করে তা দেখতে খুব মজাদার অভিজ্ঞতা মনে হত। এখন মাঝে মাঝে আমি বাংলাদেশি খাবার রান্না করি এবং নিজ হাতে খাই। এটা আমাকে আমাদের অতীতের স্মৃতিগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
আমি লন্ডনের বেথনাল গ্রিনে জীবনের সাথে বৈশাখী মেলায় গিয়েছিলাম। আমরা ঘাসের উপর বসে বাংলা গান গাই। অন্যান্য মানুষের বিস্মিত প্রতিক্রিয়া দেখে আমাদের অনেক মজা লাগে। আমি চিন্তা করছিলাম আমার গান হয়ত ঠিক আছে। পরবর্তী দিন, জীবন আমাকে জানায় যে আমাদের ভিডিও বাংলাদেশে প্রচার করা হয়েছে। এটা আমার জন্য অনেক মজাদার ছিল। আমি এখন বাংলাদেশিদের সাথে দেখা হলে কিছু কথা বাংলায় বলি। মন্ট্রিয়াল আসার পূর্বে আমি যখন ইতালিতে ছিলাম তখন আমি কিছু বাংলাদেশির সাথে পরিচিত হই। সেখানে বাঙ্গালীদের অনেক বড় কমিউনিটি রয়েছে। আমি তাদের বলি- তুমি কেমন আছ? আমি ভাল আছি এবং তারপর আমি ‘আমায় ডেকোনা’ গান গাওয়া শুরু করি। আমি তাদের চোখের বিস্ময় দেখে অনেক আনন্দিত হই। আমি তাদের সাথে একটি সংযোগ অনুভব করি, আমার মনে হয় এর আগের জন্মে আমি বাঙালি ছিলাম, হা হা।
যতজন বাংলাদেশির সাথে আমি দেখা করেছি তাদের সকলকে আমার সামাজিক ও ভাল বলে মনে হয়েছে। ভবিষ্যতে কিছু সময়ের জন্য আমার বন্ধু জীবনের সাথে বাংলাদেশে যাবার ইচ্ছা রয়েছে। কেই বা জানে, কোন পরিচালক হয়ত আমার বলা এই জীবন কাহিনী এখন পড়ছেন। আমি ইতিমধ্যে সিনেমার নাম চিন্তা করে রেখেছি ‘লুকিং ফর জীবন, লুকিং ফর লাইফ’।