খোলা বাজার২৪ : বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০১৫ টানা পাঁচ দিন ধরে পুরো ঢাকা শহর যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিল সুরের জাদুতে। দিনের আলো নিভতেই সঙ্গীতপিপাসুরা অনুভব করেছেন ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে ছুটে যাওয়ার তাগিদ। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে পর্দা নামলো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সে উৎসবের। ওস্তাদ রশীদ খান, ইরশাদ খান, সুজাত খানের উপস্থিতিতে বিদায়ের ব্যাথা কিছুটা হলেও ঘুঁচেছে।
যন্ত্রসংগীতে বংশীয় পরম্পরায় চতুর্থ প্রজন্মের প্রতিনিধি ওস্তাদ ইরশাদ খান বাজান সুরবাহার। ময়মনসিংহে উদ্ভুত ইমদাদখানি ঘরানার শিল্পী ওস্তাদ বিলায়াত খানের ভাই ইমরাত খানের সন্তান তিনি। তাদের পরিবারে সেতার ও সুরবাহার দুটোই বাজানোর প্রচলন আছে। এর প্রচলন করেন বংশের দ্বিতীয় পুরুষ ইমদাদ খান। ওস্তাদ ইরশাদ খান প্রথমবারের মতো উৎসবের মঞ্চে পরিবেশনা করেন রাগ দরবারি কানাড়া। আলাপ, জোড় শেষে তার দ্রুত থেকে অতিদ্রুত লয়ের দিকে এগিয়ে চলা ঝালা পরিবেশনায় ছিল অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা, গৎ বাজিয়ে শেষ হয় তার রাগ পরিবেশনা। পিলু রাগে ঠুমরি ছিল তার শেষ পরিবেশনা। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বাংলা ঠুমরি অঙ্গের গান ‘সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে’ যারা শুনেছেন তাদের মন নিশ্চিতভাবেই ছুয়ে গেছে সুরবাহারের ঠুমরি বাজনা। শিল্পীকে তবলায় সঙ্গত দেন পণ্ডিত যোগেশ সামসী।
ওস্তাদ বিলায়েত খানের আরেক বংশধর ওস্তাদ সুজাত খানও মঞ্চে উঠেছিলেন এদিন। তিনি সেতারে রাগ বাগেশ্রী শোনান। ইমদাদখানি ঘারানার এই শিল্পীর পরিবেশনার ঢংকে বলা হয় গায়কী অঙ্গ, স্বভাবতই একজন দক্ষ কণ্ঠশিল্পী ওস্তাদ সুজাত। আমির খসরুর একটি গজল গাওয়ার পাশপাশি তার সুর সেতারে শুনিয়েছেন তিনি। তাকে তবলায় সঙ্গত করেন অমিত চৌবে ও স্বপন আনজানিয়া। খান পরিবারের আরেক কৃতি সন্তান ওস্তাদ শহীদ পারভেজ উৎসবের তৃতীয় আসরের উদ্বোধনী দিনে সেতার বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব ২০১৫-এর সমাপনী দিন আবারও ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ শুনিয়ে গেলেন ওস্তাদ রশীদ খান। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব ২০১৫-এর সমাপনী দিন আবারও ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ শুনিয়ে গেলেন ওস্তাদ রশীদ খান। রাগ পরিবেশনার মাধ্যমে উৎসবের রং প্রতিবারই আরো বাড়িয়ে চলেছেন ওস্তাদ রশীদ খান। সেইসঙ্গে বিশেষ উপহার হিসেবে প্রতিবারের পাওয়া জনপ্রিয় ধারার গান ও ঠুমরি। শিল্পী এদিন খেয়াল পরিবেশন করেন রাগ যোগকোষে। সুরেলা কণ্ঠে তানের দক্ষতা এবারও শুনিয়ে গেলেন শিল্পী। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে গমকের জন্য বিখ্যাত তিনি। সিনেমার গান ‘ন্যায়না আপনি পিয়া সে লাগায় রে’ শুনিয়ে সবশেষে বিখ্যাত ঠুমরি ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ শুনিয়ে উৎসব শেষ হওয়ার বিষাদ কিছুটা উস্কে দিলেন। শিল্পীর সঙ্গে সঙ্গত করেন শুভঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, অজয় যোগলেকর, কৃষ্ণা বনজানে ও অভিজিৎ কুন্ডু।
আরো ছিলেন পণ্ডিত উলহাস কশলকারের ছেলে সামিহান কশলকর। শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন রাগ যোগ ও মিশ্র চারুকেশী রাগে দাদরা পরিবেশনার মাধ্যমে। তরুণ এই শিল্পীকে এদিন সঙ্গত দেন পণ্ডিত সুরেশ তালওয়ালকর ও পন্ডিত অজয় যোগলেকর।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব ২০১৫-এর সমাপনী দিন ভরতনাট্যম পরিবেশন করেন আলারমেল ভাল্লি। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব ২০১৫-এর সমাপনী দিন ভরতনাট্যম পরিবেশন করেন আলারমেল ভাল্লি। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে অংশ নেওয়া বিদুষী আলারমেল ভাল্লির ভরতনাট্যমে মুগ্ধতা আরো বেড়েছে দর্শক-শ্রোতার। কর্ণাটকি ধারার নৃত্যশিল্পী এদিন পরিবেশন করেন গীতগোবিন্দ অবলম্বনে রতি সুখসারী এবং উননুনীর ভিককিনান ও মুততাভ“ুরা পরিবেশন। আভোগী রাগে নৃত্যলহরী পরিবেশনের মাধ্যমে আলারমেল ভাল্লি শেষ করেন তার পরিবেশনা। শিল্পীর সঙ্গে সঙ্গত করেন শক্তিভেল এস সুব্রামানিয়াম, ভিসি কেসাভালু, ইশ্বর রামাকৃষ্ণণন, বসুধা রবি ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। আলোক নিয়ন্ত্রণে ছিলেন এস বিভেগানানথম।
উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি বাদন। তার বাঁশির সুরে পর্দা নেমেছে এবারের আসরের। বয়সের ভারে ন্যুজ পণ্ডিত হরিপ্রসাদ থরথর কাঁপতে থাকা হাতে বাঁশি তুলে নেন উৎসবের শেষ সুরধ্বনি শোনাতে। তিনি পরিবেশনা করেন রাগ কিরওয়ানি। এরপর রাগ জৈত শোনান রূপক ও ত্রিতালে। এরপর ছিল বিখ্যাত ভাটিয়ালি ধুন পরিবেশনা। তার সঙ্গে সঙ্গত করেন পুষ্পঞ্জলী, শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত ভবানী শঙ্কর ও দেবপ্রিয়া রনদেভ।
বাংলাদেশের অনিমেশ বিজয় চৌধুরী ও তার দল গীতিবিতান বাংলাদেশের ধামার পরিবেশনার মাধ্যমে সূচনা হয় উৎসবের সমাপনী দিনের। অধ্যাপক ড. অসিত রায়ের তত্বাবধায়নে দলটি আরো শোনান ভূপালী রাগে চতুরঙ্গ। দলটিকে সঙ্গত দেন আলমগীর পারভেজ ও অভিজিৎ কুন্ডু।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব ২০১৫-এর সমাপনী দিন সেতার শোনান ওস্তাদ সুজাত খান। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব ২০১৫-এর সমাপনী দিন সেতার শোনান ওস্তাদ সুজাত খান। আসরের সমাপনী আনুষ্ঠানিকতায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, ভারতের রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ সরণ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ এ সামাদ, প্রধানমন্ত্রীর আর্ন্তজাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ, শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামন ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।
বরাবরে মতোই আর্মি স্টেডিয়ামে এবারের উৎসব শুরু হয় ২৭ নভেম্বর। এবার অংশ নিয়েছেন দুশোর বেশি শিল্পী, যাদের মধ্যে প্রায় ৮০ জন বাংলাদেশি।
প্রথমবারের মতো এবারের উৎসবের অংশ নিয়েছেন বিখ্যাত তবলিয়া ড. বালামুরালি কৃষ্ণা ও পণ্ডিত রণু মজুমদার, ওস্তাদ জাকির হোসেন, ওস্তাদ ওয়াসিফউদ্দিন ডাগর, ড. এন রাজম ও তার তিন উত্তরসূরী – মেয়ে ড. সঙ্গীতা শঙ্কর এবং দুই নাতনি রাগিনী শঙ্কর ও নন্দিনী শঙ্কর, বিদুষী শ্র“তি সাদোলিকর, জয়াপ্রদা রামামূর্তি, জয়ন্তী কুমারেশ, কৃচিপুরি নৃত্যশিল্পী দম্পতি গুরু রাজা রেড্ডি ও রাধা রেড্ডি এবং গণেশ ও কুমারেশ রাজাগোপালান।
বরাবরের মতোই আসর মাতিয়েছেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, কারাইকুরি মানি ও তার তালবাদ্যর দল, পণ্ডিত উলহাস কশলকর, বিদুষী বোম্বে জয়শ্রী, পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর, কৌশিকী চক্রবর্তী, রাহুল শর্মা।