খোলা বাজার২৪ ॥ রবিবার, ১৫ নভেম্বর ২০১৫: প্রথমবারের মতো এত বড় আয়োজন – আন্তজার্তিক লোকসঙ্গীত উৎসবে ভূল হওয়ার অবকাশ তাই ছিল। তবে ভুল -ত্রুটি ছাপিয়ে গেছে শ্রোতাদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি আর শিল্পীদের অনবদ্য পরিবেশনা। তিন দিনের এই আসরে শিল্পীরাও যেমন গান গাইতে উৎসুক ছিলেন, তেমনি শ্রোতাদেরও গান শুনে যেন পিপাসা মেটেনি। আর তাই ভবিষ্যতে আরো বড় পরিসরে, সুসংহতভাবে এই আয়োজন হোক – সেই আকাক্সক্ষাই প্রতিধ্বণিত হয়েছে।
শেষ দিনের আয়োজনকে আলোকিত করেছেন জলের গান, ভারতের পার্বতী বাউল, ফিউশন ব্যান্ড ইন্ডিয়ান ওশেন, রাজস্থানের ম্যাঙ্গানিয়ার গোষ্ঠীর শিল্পীরা, পাকিস্তানি শিল্পী আবিদা পারভীন, আয়ারল্যান্ডের শিল্পী নিয়াভ নিকারা। আনুশেহ আনাদিল, কাঙ্গালিনী সুফিয়ার গান গাওয়ার কথা থাকলেও তাদের শেষ পর্যন্ত দেখা যায়নি।
তৃতীয় দিনের আসর শুরু হয় বাংলাদেশের ব্যান্ড জলের গানের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। রাহুল আনন্দ, কনক আদিত্যরা ‘শুয়া যাও রে’ গানটি শুরু করতেই উৎসবের তরুণ শ্রোতারা কণ্ঠে তুলে নিলেন গানটি। জলের গান মানেই তো কাহন-চন্দ্রবান-নয়নতারা-মন্দোলার মতো স্ব-উদ্ভাবিত বাদ্যযন্ত্রের ধুন। গানের ফাঁকে ফাঁকে এই ধুন মাতিয়েছে শ্রোতাদের। একে একে তারা পরিবেশন করলেন ‘বকুল ফুল’, ‘ও ঝরা পাতা’, ‘এই পাগলের ভালোবাসা নিও’, ‘আমি একটা পাতার ছবি আঁকি’ গানগুলো।
জলের গানের পরই মঞ্চে আসে আয়ারল্যান্ডের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের লোকগানের শিল্পী নিয়াভ নিকারা। মাত্র চার বছর বয়সে লোকসঙ্গীতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন এই শিল্পী। আয়ারল্যান্ড মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস অনুষ্ঠানে ২০১৪ সালের সেরা নারী সংগীতশিল্পী নির্বাচিত নিয়াভ এসেই বললেন, “আমাদের দেশ আয়ারল্যান্ডে তো কেবল দুটি ভাষায় কথা বলি, এক আইরিশ, আরেক ইংরেজি। কিন্তু এখানে এসে দেখছি, সবাই একটি ভাষাতেই কথা বলছে, তা হলো বাংলা। বাংলা লোকগান নিয়ে যতোই পড়ছি, অবাক হচ্ছি। আমরা সাত হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এই বাংলায় গাইতে এসেছি, আমাদের সত্যি অনেক ভালো লাগছে।” গিটার, পারকাশনের ধুন দিয়ে পরিবেশনার শুরু হলো। কিছুদিন আগে মুক্তি পাওয়া ‘কজ’ অ্যালবাম থেকে একে একে গাইলেন প্রেম আর বিরহের বেশ কটি গান। নিয়াভ তার ব্যান্ড নিয়ে তিনটি ইন্সট্রুমেন্টাল অ্যালবামও নাকি বাজারে এনেছে। সেই অ্যালবামগুলো থেকেও তিনটি ইনস্ট্রুমেন্টাল ট্র্যাক পরিবেশন করলেন তারা।
উৎসবস্থলে ততক্ষণে হাজির হয়েছেন শেষ দিনের আসরের প্রধান অতিথি সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। প্যারিসে একাধিক সন্ত্রাসী হামলার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বললেন, “কিছু কিছু দেশ আছে যারা আমাদের দেশে নাকি নিরাপদ বোধ করে না। কিন্তু আমার সামনে এই যে তরুণ সমাজ রাতের পর রাত জেগে ফোক গান শুনছে, এটাই প্রমাণ করে যে এ দেশে কখনো সন্ত্রাসের স্থান হবে না।”
ভারতীয় লোকগানের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীত ধারার সম্মিলন ঘটানোর কারণে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ভারতীয় ব্যান্ডদল ইন্ডিয়ান ওশেন। দলটির বেইজ গিটারিস্ট ও ভোকাল রাহুল রাম বললেন, “মায়ের দিক থেকে এই বাংলার সঙ্গে কিন্তু আমার যোগাযোগ অনেক আগের । মংলার মেয়ে মা বড় হয়েছেন দিল্লীতে, আমিও তাই। আমি খুব ভালো বাংলা বলতে পারি না। কিন্তু আমি আপনাদের জন্য বাংলাতেই বলছি। ভুল হলে ক্ষমা করবেন যেন!”
ছোট বেলায় শেখা দক্ষিণ ভারতের একটি লোকগানের আসর মাতানো পরিবেশনার পর তুললেন প্যারিসের সন্ত্রাসী হামলার প্রসঙ্গ। ধর্মীয় হানাহানি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে তাদের গান ‘আরে রুক যারে বান্দে’ ব্যবহৃত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে মুম্বাইয়ে বোমা হামলা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’তে। সে গানটি গাইলেন প্যারিসে অভাবনীয় সহিংসতা স্মরণে। গানটির সুরে উৎসব প্রাঙ্গনে নেমে এল বিষাদ আর ক্ষোভের ছায়া।
যে উৎসব প্রাণের উৎসব, সে উৎসবে কি বিষাদ মানায়! তাই ইন্ডিয়ান ওশেন ফিরে গেলেন আনন্দ-আয়োজনে। ভারতের মধ্য প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ‘মা রেওয়া’ পরিবেশন করলেন তারা। তবে তার আগে অমিত কিলাম আর রাহুল রামের গাবগুবি-বেইজ গিটারের দ্বৈরথ জাগিয়ে তুলল শোকাতুর শ্রোতাদের। তাদের শেষ পরিবেশনা ছিলো ‘আলম আলম’।
পার্বতী বাউলের গানের সঙ্গে অবশ্য পরিচিত ঢাকার শ্রোতারা। কমাস আগেই তো মাতিয়ে গেলেন শিল্পকলায়। এদিনের আসরে তার পরিবেশনার বিষয় শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা। শিল্পীর পরিবেশনার সঙ্গে যোগ হলো ভারতীয় বাংলা টিভি সিরিয়ালগুলোর নিয়মিত অভিনেত্রী রিতা দত্ত চক্রবর্তীর আবৃত্তি। রিতা দত্তই শুরু করলেন আগে, পংক্তিতে তিনি বলে গেলেন রাস উৎসবের আগে শ্রীকৃষ্ণ-রাধার মান-অভিমানের পৌরাণিক আখ্যান। জট-বাধা বিশাল চুল, পরনে গেরুয়া বসন, হাতে একতারা, কোমরে বাধা ডুগডুগি, পায়ে মল – পার্বতী যখন মঞ্চে এলেন তুমুল হর্ষধ্বনিতে তাকে স্বাগত জানালেন শ্রোতারা।
উচ্চাঙ্গ সংগীতের মাধ্যমে গানের ভুবনে প্রবেশ, পরে কত্থক নৃত্যে তালিম গ্রহণ, পড়াশোনা করেছেন ভিজ্যুয়াল আর্টসে। শান্তিনিকেতনে পড়তে পড়তে একদিন প্রেমে পড়লেন বাউল গানের। তারপর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মৌসুমী পারিয়াল হয়ে গেলেন পার্বতী বাউল।
গানের ফাঁকে ফাঁকেই রিতা দত্ত বলে চলেছেন রাধার অভিমান পর্বের কথা। বললেন, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি রাধার অনুযোগের গল্পও। তারপর আর কী! সুরে সুরে রাধারূপী পার্বতী গেয়ে গেলেন, ‘কালো কেন রাই’, ‘তমসি মম’ গানগুলো। শেষে গাইলেন মান ভঞ্জনের গান ‘রাধা গোবিন্দের যুগল মিলন’।
এরপর মঞ্চে উঠলেন পাকিস্তানের কাওয়াল আবিদা পারভিন। ‘ও জি মওলা’, ‘ইয়ার কো হামনে’, ‘থাইয়া থাইয়া’ আর সবশেষে গাইলেন ‘দামা দাম মাস্ত কালান্দার’।
সব শেষে মঞ্চে এলেন রাজস্থানের ম্যাঙ্গানিয়ার গোষ্ঠীর শিল্পীরা। মুসলমান এই শিল্পীরা নিজেদের বিশেষ ধরনের গান ও বাদ্যযন্ত্রের জন্য পরিচিত। রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী লোকগানের পরিবেশনার অংশ হিসেবে ছিল ‘নিম্বুরা নিম্বুরা’ গানটি। পরিবেশনার আগেই অবশ্য তারা জানিয়ে দিয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হাম দিল দে চুকে সানাম’ সিনেমার গানটির সঙ্গে কোনো মিল নেই এটির। হলোও ঠিক তাই।
এখানেই শেষ নয়। হঠাৎ এই শিল্পীরা বাংলায় গাইতে শুরু করলেন -‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’। আর এভাবেই এক চমকপ্রদ সমাপ্তি ঘটলো মন মাতানো এক আসরের।