খোলা বাজার২৪,মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬: সদর দফতরের কঠোর হুশিয়ারি এবং নজরদারির পরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না পুলিশের অপরাধ প্রবণতা। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। টাকা না পেয়ে নির্যাতন, মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া, সাধারণ মানুষকে হয়রানিসহ পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ প্রায়ই অহরহ। মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ কিংবা হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগও আসছে মাঝে-মধ্যে। সদর দফতরের হিসাব মতে, ২০১৫ সালে সিকিউরিটি সেলে প্রায় পাঁচ হাজার গুরুতর অভিযোগ জমা পড়েছে। এর বাইরে নৈতিক স্খলন ও আচরণগত সমস্যার অভিযোগ জমা পড়েছে প্রায় ৩ হাজার। তবে শাস্তি হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩৪ জনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ফৌজদারি অপরাধে ৭৪ জনকে গুরুদ- এবং অন্যান্য অপরাধে ৯৬০ জনকে লঘুদ- দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সদর দফতরের সিকিউরিটি সেল ছাড়াও জেলা পর্যায়ের পুলিশ সুপারের কার্যালয়েও প্রতি মাসে শত শত অভিযোগ জমা পড়ছে। এসব অভিযোগ তদন্তে কমিটিও হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ তদন্তের রিপোর্টই আলোর মুখ দেখছে না। অন্যদিকে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে মামলাসহ নানা হয়রানির মুখে পড়ছেন অনেকেই। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে আসা বেশিরভাগ অভিযোগ তদন্তেই বন্দি থাকছে। কালক্ষেপণ আর রাজনৈতিক প্রভাবে বেশিরভাগ অভিযোগেরই সঠিক তদন্ত ও শাস্তি হয় না। ফলে ভয়ংকর অপরাধে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরাও পার পেয়ে যাচ্ছেন।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, কোনো পুলিশ সদস্য বড় ধরনের অপরাধ করলে হইচই পড়ে যায়। এরপর ওই সদস্যকে প্রত্যাহার কিংবা সাময়িক বরখাস্ত করেই দায়িত্ব শেষ করে পুলিশ সদর দফতর। পরে সঠিক নজরদারি না থাকায় কিংবা তদন্ত কমিটিকে ম্যানেজ করে ফের চাকরিতে যোগ দিয়ে ওই পুলিশ সদস্য আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। পুলিশের অনৈতিক আচরণসহ অন্যান্য অভিযোগের তদন্ত নিজস্ব বাহিনীর পরিবর্তে অন্য বাহিনীকে দিয়ে করা হলে অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
তবে এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সোমবার তিনি বলেন, ‘প্রায় পৌনে ২ লাখ জনবলের বিশাল এ বাহিনীতে দু-একজন অপরাধ করতেই পারেন। তবে কোনো পুলিশ ন্যূনতম অপরাধ করলেও সে বিষয়ে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ ব্যাপারে কারও প্রতি ন্যূনতম অনুকম্পা দেখানো হয় না।’
একই কথা বলেছেন পুলিশের আইজি একেএম শহীদুল হক। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অসদাচরণের যে অভিযোগ উঠেছে তা তদন্তে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্তের পর কমিটিগুলোর সুপারিশ অনুযায়ী দোষীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইজিপি বলেন, কোনো অপরাধে সাধারণ মানুষের যে শাস্তি হয় একই অপরাধে পুলিশ সদস্যদের আরও কঠোর শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতর সব সময় জিরো টলারেন্স দেখিয়ে থাকে।
মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক আশরাফুল আলম বলেন, প্রথমত পুলিশ বাহিনীকে শারীরিক প্রশিক্ষণের বাইরে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও জনগণের কাছে তাদের যে দায়বদ্ধতা সে বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তার মতে, নিয়োগের পর পুলিশ সদস্যকে যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সেটা মূলত প্রভিশনাল পর্যায়ে। সেখানে পুলিশের পেশাগত নিয়ম-কানুনের বাইরে নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে খুব বেশি শিক্ষা দেয়া হয় না। এ কারণে পেশায় যোগদানের পর একজন পুলিশ সদস্য নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বলে তিনি মনে করেন।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে সদর দফতরের সিকিউরিটি সেলে ৭ হাজার ৯১৬ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ জমা পড়ে। যার মধ্যে গুরুতর অভিযোগ এসেছে ৪ হাজার ৭৮৮ জনের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ কিংবা মাদক ব্যবসার মতো অভিযোগও রয়েছে। বাকি ৩ হাজার ৯১২ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে টাকা না পেয়ে নির্যাতন, বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া, সাধারণ মানুষকে হয়রানিসহ বিভিন্ন অসদাচরণের।
গত বছর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে ঘটনাস্থলেই হাতেনাতে ৩২ পুলিশ সদস্য ধরা পড়েছেন বলে সদর দফতর সূত্র জানায়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৩৪ জনের বিরুদ্ধে। গুরুতর অভিযোগে গত বছর মোট ৭৪ জনকে চাকরিচ্যুত ও বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে কনস্টেবল ও এএসআই পর্যায়ের সদস্য বেশি। এছাড়া বিভিন্ন অভিযোগে লঘুদ- দেয়া হয়েছে ৯৬০ পুলিশ সদস্যকে। এর মধ্যে অনেকের নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য বেতন স্কেলে দক্ষতাসীমা অতিক্রম বন্ধ, বেতন স্কেল নিু ধাপে অবনমিতকরণ এবং কর্তব্যে অবহেলায় সরকারের আর্থিক ক্ষতির সম্পূর্ণ বা অংশবিশেষ বেতন হতে আদায় করা হচ্ছে।
সদর দফতর সূত্র আরও জানায়, প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃংখলা ও আপিল) বিধিমালা-১৯৮৫ অনুযায়ী অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়া সদর দফতরে পুলিশের বিরুদ্ধে আইনশৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসূত্র রয়েছে এমন অভিযোগে ১ হাজারেরও বেশি সদস্যের বিরুদ্ধে বর্তমানে তদন্ত চলছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিকিউরিটি সেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাকি অভিযোগগুলোও পর্যায়ক্রমে আমলে নিয়ে তদন্ত করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নূরুল হুদা বলেন, একটি সুশৃংখল বাহিনীর সদস্যদের অপরাধে জড়ানোর খবর দুঃখজনক। তার মতে, এ ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো খুবই জরুরি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুপারভিশনের অভাবেই অধস্তনরা সাধারণ কিংবা ফৌজদারি নানা অপরাধে জড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
আরেক সাবেক মহাপরিদর্শক এমএ কাইয়ুম রাজনৈতিক বলয়ে জড়িয়ে পড়ায় পুলিশে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে দাবি করেন। পুলিশের সাবেক এ শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে পুলিশ সদস্যদের বড় একটি অংশ সব সময় ক্ষমতাসীন দলের উ”চমহলে যোগাযোগ রাখছে। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় এসব সদস্য সব সময় বেপরোয়া আচরণ করে থাকেন। এদের চেইন অব কমান্ড ভাঙার প্রবণতাও বেশি। তার মতে, দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে না পারলে এ বাহিনীকে সাধারণ মানুষের প্রকৃত সেবক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
৯ জানুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী টহল পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। রাব্বী অভিযোগ করেন, মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ শিকদারসহ পুলিশ ও আনসারের পাঁচ সদস্য তাকে আটকের পর ৫ লাখ টাকা দাবি করে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর আহত করেন।
এর ৫ দিন পর ১৫ জানুয়ারি ভোরে রাজধানীর মীর হাজীরবাগে কর্তব্যরত অবস্থায় সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে আহত করে পুলিশ। যাত্রাবাড়ী থানার এসআই আরশাদ হোসেন আকাশের নেতৃত্বে ৫ থেকে ৬ জন পুলিশ বিকাশকে ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে মারধর করে বলে অভিযোগ করেন বিকাশ চন্দ্র দাস। পুলিশের প্রহারে আহত এ দু’জন বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
একই দিন গভীর রাতে কমলাপুর রেল স্টেশনে ওভারব্রিজের ওপর এক হিজড়াকে যৌন হয়রানি ও মারধর করার অভিযোগ ওঠে। কমলাপুর রেল পুলিশের কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনেন হান্নান ওরফে টোকাই হান্নান নামে এক হিজড়া। এ সময় তার মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় বলেও তিনি অভিযোগ করেন। এমনকি এ ব্যাপারে অভিযোগ করতে গেলে কমলাপুর জিআর পুলিশ তাকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয় বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তবে রেলওয়ে থানা পুলিশ প্রথম থেকেই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
এদিকে শনিবার বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার শিহিপাশা গ্রামে পুলিশের বেধড়ক পিটুনিতে গুরুতর আহত হন ব্যবসায়ী বাদল সেরনিয়াবাত। রাস্তার পাশে গাছ ফেলে রাখার অপরাধে আগৈলঝাড়া থানার ওসি মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ ওই ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে আহত করে। ওই ব্যবসায়ীও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনা জানাজানি হলে জেলা পুলিশ সুপার আক্তারুজ্জামান ওসির গাড়িচালক কনস্টেবল মোকলেসুর রহমানকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহারের (ক্লোজড) নির্দেশ দেন। তবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন ওসি মনিরুল ইসলাম। যুগান্তর
স্থানীয় সময় : ০৫০০ ঘণ্টা, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬