Mon. Mar 17th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

28kখোলা বাজার২৪,বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ ২০১৬: নির্মলেন্দু গুণের কবিতার অনুপ্রেরণায়)
[ভূমিকা: এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা অবলম্বনে পরিকল্পনাহীন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের আপাত চিত্রনাট্য। বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনা ও বিষাদের এ দিনটিকে একটু অন্যভাবে অন্য আঙ্গিকে দেখার মানসেই এই চিত্রনাট্যের প্রয়াস। চিত্রনাট্যটির সংশোধন পরিবর্তন ও পরিবর্ধন চলমান। ]
দৃশ্য এক
দিন। ঢাকা, বহিরাঙ্গন। হোটেল শেরাটন-সংলগ্ন অঞ্চল।
শহরে আজ একটা ভীষণ অস্বস্তি। রোদ আর বাতাসও কেমন যেন থমকে আছে। একটি টি-৯৪ জলপাই রঙা ট্যাংক শেরাটন হোটেলের ঠিক উল্টো দিকের সড়কে আড়াআড়িভাবে রাখা। মাঝেমধ্যে দু-একটি রিকশা ও প্রাইভেট কার খুব দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যায়। অডিওতে সেদিনকার রেডিও ভাষ্যে শোনা যায়—
‘প্রিয় দেশবাসী, আমি খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়েছি। আপনারাৃ’ (সেদিনকার রেডিও ভাষ্যটি প্রচার করা হবে।)
কাট টু
হাতিরপুলের খালসংলগ্ন মাটির কাঁচা সড়কের পাশে বাজার থেকে কুড়িয়ে আনা চাল এদিক-সেদিক ছড়াচ্ছে আর ‘তই তই’ বলে পাখিদের ডাকছে মনা পাগলা। অন্যদিন রাজ্যের পাখি এসে এখানে জড়ো হতো। মনার দেওয়া চাল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেত। কিন্তু আজ একটাও পাখির দেখা নেই। মনা শূন্য দৃষ্টি নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোথাও একটা পাখি নেই। স্তব্ধ শহরটাকে বড্ড নির্মম লাগে দেখতে।
দৃশ্য দুই
১৫ আগস্ট। রাত ১২: ৩০ মিনিট। ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন।
শেখ জামালের স্ত্রী, শেখ কামালের স্ত্রী, শেখ নাছেরের স্ত্রীর সঙ্গে বাড়ির দু-একজন কাজের মেয়ে মিলে কোনো একটা কিছু নিয়ে বেশ হাসাহাসি করছে। হয়তো শেখ রাসেল স্কুলে শিখে আসা একটা কৌতুক বলছে। আর তা শুনেই বাড়ির মেয়েরা হাসিতে ভেঙে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণত এত রাত অবধি জেগে থাকেন না। আজ কেমন একটা গুমোট গরম পড়েছে। তিনি বারান্দার হেলান চেয়ারে বসে নিভে যাওয়া পাইপটাতে আবার আগুন ধরালেন। নাকেমুখে ধোঁয়া তুলে কয়েকটা কাশি দিলেন বঙ্গবন্ধু। ইদানীং এই কাশিটা তাঁকে বড্ড ভোগাচ্ছে। ৩২ নম্বরের জনশূন্য রাস্তায় একটা বয়স্ক মেয়ে কুকুর কেন যেন করুণ সুরে কাঁদছে। ঠোঁট থেকে পাইপটা নামিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে থাকেন বঙ্গবন্ধু। কেন যেন পাইপের ধোঁয়া তাঁর কাছে অসহ্য মনে হয়। কুকুরটা ডেকেই চলছে।
দৃশ্য তিন
কালো অধ্যায়। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী১৫ আগস্ট। রাত ০৩: ৩০। শহরের রাস্তা।
শহরের রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। মনা পাগলার নির্দিষ্ট কোনো থাকার জায়গা নেই। আজ সে ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের যাত্রী ছাউনির নিচে শুয়ে আছে। বিড়িতে সুখটান দিতে দিতে তাঁর ক্লান্ত চোখ আধবোজা হয়ে আসে। হঠাৎ একটা, দুইটা তারপর তিনটা ট্যাংক কিছু সময় পরপর শহরের কংক্রিটের রাস্তা প্রকম্পিত করে এগিয়ে আসতে থাকে। সহসাই মনা পাগলার চোখ থেকে ঘুম উবে যায়। উঠে বসে দেখতে থাকে ট্যাংক আর আর্মির জিপের বহর। ইলেকট্রিক খুঁটির ওপর গিয়ে বসে একটা দাঁড়কাক। তারস্বরে দুবার ডাক দিল কাৃ কাৃ
দৃশ্য চার
১৫ আগস্ট। রাত ০৪:৪০। বঙ্গবন্ধু ভবন।
একটা জিপ গাড়ির আলো যেন দোতলার বঙ্গবন্ধুর ঘরের জানালার কাচের ওপর নেচে যায়। বঙ্গবন্ধুর ঘুম খুব পাতলা। কিন্তু আজ কিছু একটা স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। স্পষ্টতই তাঁর চেহারায় একটা অস্বস্তির ছাপ। নিচে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। হট্টগোল শুনে তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না, এ কি স্বপ্ন, না বাস্তব? নিরাপত্তাকর্মী সিদ্দিকের গলার শব্দ শুনতে পান, সঙ্গে আরও কয়েকটি অপরিচিত কণ্ঠস্বর। বঙ্গবন্ধু উঠে বসেন। চোখে চশমাটি পরেন। পাশে রাখা কাচের গ্লাসের পুরো পানিটা ঢক ঢক করে পান করেন।
দৃশ্য পাঁচ
১৫ আগস্ট। রাত ০৪:৫২। বঙ্গবন্ধু ভবন।
দুজন জওয়ান শুরু করে একটানা ব্রাশফায়ার। পাশের বাড়ির হুলোবিড়ালটা হয়তো মাছের লোভে গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করেছিল। একটা বুলেট উড়িয়ে নিয়ে গেল বাদামি রঙা বিড়ালটার মাথার একপাশ। ক্যামেরার ফোকাস শিফট করলে আমরা দেখতে পাই ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া শেখ কামালের শরীরটা। অস্ফুট স্বরে হয়তো ‘আব্বা’ বলে ডাকছেন। তাঁর হাতের পিস্তল থেকে সদ্য বুলেট বের হওয়ার ধোঁয়ার আভা দেখা যায়। হতবাক জওয়ান কিছু না বুঝেই আরেকবার লক্ষ স্থির না করেই মেশিনগান থেকে গুলি চালায়। কাচের আলমারিতে থাকা বইগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর কাঁধে হাত রাখা ভাসানীর একটা ছবি স্লো মোশনে শূন্যে ভাসে। নারী-পুরুষ কণ্ঠের আর্তচিৎকার আর মিলিটারি বুটের ধুপ ধাপ শব্দ ৩২ নম্বর সড়কের অন্য সব বাড়ির মানুষজনেরও ঘুম ভাঙিয়ে দেয়।
দৃশ্য ছয়
১৫ আগস্ট। রাত ০৪:৫৫। বঙ্গবন্ধু ভবন।
সাদা পাঞ্জাবিটা গায়ে চাপিয়ে দৃপ্ত পায়ে দোতলার সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। সিঁড়ির নিচের অংশে দাঁড়ানো দু-তিনজন সেনা। তাঁদের হাতে ভারী অস্ত্র। বঙ্গবন্ধু বজ্র স্বরে বলে ওঠেন ‘এই তোমরা কারা? কার অনুমতিতে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছ?’ সামনে দাঁড়ানো সেনা সদস্যরা শক্তির অপর্যাপ্ততা অনুভব করে। কোনো শব্দ না করে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁরা। একজন সেনা কর্মকর্তা পেছন থেকে বিষয়টা দেখেন। বঙ্গবন্ধু নিজের ভেতরের উদ্বেগ আর অজানা শঙ্কা দূর করতেই হয়তো তাঁর হাতের পাইপে কয়েকটা টান দিলেন। আর ঠিক তখনই খুব কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা সেনা কর্মকর্তা নির্লিপ্ত ভঙ্গি নিয়ে মেগিনগানের ট্রিগারে আঙুলের চাপ দিলেন। মুহূর্তেই এক ঝাঁক বুলেট গিয়ে বিদীর্ণ করে দেয় বাঙালির জাতির জনকের, বঙ্গবন্ধুর, শেখ মুজিবুর রহমানের দেহটি। স্লো মোশনে জাতির জনকের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহটি সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নিচে নেমে আসতে থাকে।
দৃশ্য সাত
১৫ আগস্ট। সকাল ০৫:১০। বঙ্গবন্ধু ভবন ও অন্যান্য লোকেশন।
একটি মসজিদের মিনার দেখি। মধুর স্বরে কোনো এক মুয়াজ্জিন ফজরের আজান দিচ্ছেন।
কাট টু
দেয়ালটা ক্ষতবিক্ষত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা একপাশে হেলে গিয়ে তির্যক হয়ে ঝুলছে। ক্লোজশটে রবি ঠাকুরকে দেখতে ভীষণ বিষণœ লাগছে।
কাট টু
ক্যামেরা বাড়িটার ভেতরে প্রদক্ষিণ করে। এখানে-সেখানে বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নিথর রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। তখনো কোনো কোনো সেনাসদস্য আলমারি ভেঙে টাকা আর মূল্যবান সামগ্রী লুটের মানসে ব্যস্ত।
কাট টু
বঙ্গবন্ধুর ডান হাতের মুঠিতে ধরে রাখা পাইপটা নিভে গেছে। চশমাহীন চোখটা জলে ভেজা। বঙ্গবন্ধুর ঠোঁটটা তখনো ঈষৎ নড়ছে। যেন-বা তিনি কিছু বলার চেষ্টা করছেন।
কাট টু
ফ্ল্যাশব্যাক ১
কিশোর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শিশু ফজিলাতুন্নেসার বিয়ের একটি মুহূর্ত।
কাট টু
ক্লোজশটে দেখি বঙ্গবন্ধুর চোখ বেয়ে অশ্র“ধারা নেমে আসছে।
ফ্ল্যাশব্যাক ২
শিশু বঙ্গবন্ধুকে তার মা ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন।
ফ্ল্যাশব্যাক ৩
গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে বক্তব্য দিচ্ছে কিশোর বঙ্গবন্ধু।
ফ্ল্যাশব্যাক ৪
বড় মেয়ে শেখ হাসিনার বয়স তখন এক কি দেড়। আধো আধো বুলিতে বাবাকে যেন কী বলছে মেয়েটা। কী বুঝেছেন কে জানে, তবে বঙ্গবন্ধু খুব হাসছেন।
ফ্ল্যাশব্যাক ৫
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর এক বৃদ্ধা বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। বঙ্গবন্ধুর চোখও অশ্র“সজল।
ফ্ল্যাশব্যাক ৬
বিশাল আকৃতির বাংলাদেশের পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর প্রিয় বাঙালি ভাইবোনেরা।
কাট টু
চতুর্দিক একেবারে নিঃশ্চুপ, নিস্তব্ধ। দমকা একটা বাতাস সঙ্গে করে উড়ে নিয়ে আসে কয়েকটি শুকনো পাতা। বঙ্গবন্ধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, প্রাণ তাঁর শরীর ত্যাগ করে।
কাট টু
৩২ নম্বরের সামনের লেকের আকাশে শত শত পাখি দেখতে পাই। এত পাখি আমরা আগে কখনো দেখিনি। আকাশ কালো করে পাখির দল কোথায় যেন উড়ে চলেছে।
অ্যান্ড স্ক্রল।