খােলা বাজার২৪।। বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০১৭: চিরনিদ্রায় চলে গেলেন বলিউডের চিরসবুজ ব্যক্তিত্ব বিনোদ খান্না। তাঁর মতো ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ফিল্মি দুনিয়ায় বিরল। পর্দায় নায়ক, খলনায়ক, কৌতুক—সব ধরনের চরিত্রে দেখা গেছে তাঁকে। বর্ণময় ছিল তাঁর বাস্তবজীবনও। বিনোদ খান্নার প্রয়াণে শোকের ছায়া নেমে আসে বলিউডে। শুধু ভালো অভিনেতা হিসেবে নয়, সবার স্মৃতিতে তিনি অমর হয়ে থাকবেন তাঁর সুন্দর মননের জন্য। প্রথম আলোর কাছে বিনোদ খান্নার বিভিন্ন সময়ের চার নায়িকা সেই মননশীল অভিনেতাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন। তাঁদের টুকরো টুকরো স্মৃতিতে জানা গেল অজানা বিনোদকে।
সায়রা বানু
বিনোদের সঙ্গে নায়িকা হিসেবে আমার প্রথম ছবি আরোপ। এ ছাড়া নেহলে পে দেহলা, হেরাফেরির মতো হিট ছবি আমরা করেছি। এই দুটো সিনেমায় প্রচুর মারপিটের দৃশ্য ছিল। শুটিংয়ের সময় এসব দেখে তো আমার হাত-পা ঠান্ডা। তখন বিনোদ আমায় সাহস জোগান। তিনি স্ট্যান্টম্যান ছাড়াই সব মারপিটের দৃশ্য করেন। আমাকে শেখান কীভাবে অ্যাকশন করতে হয়। কীভাবে বাইক চালাতে হয়। এমনকি আমি তাঁর কাছ থেকে রীতিমতো কারাতের প্রশিক্ষণ নিই। মানুষ হিসেবে তিনি খুবই কেয়ারিং ছিলেন। একবার নটরাজ স্টুডিওতে আমি আমার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। আমার সঙ্গে অনেক জিনিসপত্র ছিল। বিনোদ খান্না এসে বলেন, ‘চলো, আমি তোমাকে ড্রাইভ করে বাড়ি পৌঁছে দিই।’ আমরা লোনাভালাসহ একাধিক জায়গায় আউটডোর শুটিং করেছি। দারুণ মজা করে কাজ করতাম। তিনি বাড়ির সব ধরনের কাজ করতে পারতেন। আমি নিজের চোখে দেখেছি, একবার তাঁর বাড়ির পানির কল খারাপ হয়ে যায়। মিস্ত্রি না ডেকে বিনোদ নিজেই কল মেরামতির কাজে লেগে পড়েন।
হেমা মালিনী
অভিনয় ও রাজনীতি—দুই জগতেই আমার সঙ্গী ছিলেন বিনোদ। তবে এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে, আমাদের সম্পর্কটি ছিল নির্মল বন্ধুত্বের। অভিনয়ের আঙিনায় কখনো নায়ক, কখনো সহনায়ক, আবার কখনো খলনায়ক হিসেবে পেয়েছি তাঁকে। তাঁর নায়িকা হিসেবে রিহাই ও কুদরত আমার অত্যন্ত প্রিয় ছবি। বিনোদের লুকটাই ছিল ভীষণ শহুরে। তারপরও রিহাই সিনেমায় তিনি ধুতি পরে গ্রাম্য ছুতোর-মিস্ত্রির চরিত্র খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন। রজনীশের আশ্রম থেকে ফিরে আসার পর আবার আমরা গুলজার সাহেবের ছবি মীরাতে একসঙ্গে অভিনয় করি। তখন এক অন্য বিনোদকে আবিষ্কার করি। তাঁর অভিনয়জীবনের শেষ ছবিটা আমার সঙ্গে করেন। আমরা একসঙ্গে এক থি রানি অ্যায়সি ভিতে কাজ করি। আর এটাই আমার পরম পাওয়া যে বিনোদ তাঁর শেষ কাজটি আমার সঙ্গে করেছেন। অনেকেরই হয়তো জানা নেই, আমার রাজনীতিতে আসা বিনোদের হাত ধরেই। একদিন তিনিই আমাকে ফোন করে জানান যে গুরুদাসপুরে বিজেপির প্রার্থী হয়ে লোকসভা নির্বাচনে লড়ছেন। আমাকে তাঁর নির্বাচনী প্রচারে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। আমি প্রথমে শুনেই না করে দিই। আমার মা আমাকে বলেন, ‘বিনোদ তোমার এত কাছের বন্ধু। আজ তুমি ওর পাশে দাঁড়াবে না?’ আর এভাবেই আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু।
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়
বিনোদজির মৃত্যুর পর আমি এই প্রথম কোনো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলছি। বিনোদ খান্নার ব্যাপারে কিছু বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি ওর প্রথম স্ত্রী গীতাঞ্জলিকে আদর করে ‘গীতলি’ বলে ডাকতাম। গীতলি আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। গীতলি সব সময় সেটে আমার জন্য খাবার পাঠাত। আমি এবং বিনোদ একসঙ্গে বসে খেতাম। এমনকি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী কবিতাও আমার জন্য খাবার পাঠাতেন। বিনোদজির প্রথম পক্ষের দুই ছেলে—রাহুল আর অক্ষয় আমার সন্তানের মতো। ছোটবেলায় ওরা আমার সঙ্গে খেলত। নানা রকম আবদার করত। বিনোদ কখনো নিজের ছেলেদের জন্য বলিউডে কারও কাছে সুপারিশ করেননি। আজ ওরা যা হয়েছে, তা নিজেদের যোগ্যতায়। আমি যখন ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট’ পুরস্কার পাই, বিনোদ তখন দিল্লি থেকে ফোন করে আমাকে অভিনন্দন জানান। তাঁর সঙ্গে অভিনীত আমার প্রথম ছবি কাচ্চে ধাগে। এ ছাড়া আরও তিনটি সিনেমায় তাঁর নায়িকা হিসেবে কাজ করেছি। এমনকি অক্ষয় ও রাহুলের মায়ের চরিত্রেও আমি অভিনয় করেছি। বলিউডের দুজন ব্যক্তিত্বকে আমি খুবই শ্রদ্ধা করি—একজন বিনোদ খান্না, অপরজন ঋষি কাপুর। অভিনেতা বিনোদের পাশাপাশি মানুষ বিনোদকেও চলচ্চিত্র দুনিয়া আজীবন মনে রাখবে।
অরুণা ইরানি
অমিতাভ বচ্চন ও বিনোদ খান্নার মধ্যে খুবই স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা হতো। কিন্তু দুজনেই ছিলেন অভিন্নহৃদয়ের বন্ধু। এখনকার নায়কদের মতো তাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে কখনো কাদা ছোড়াছুড়ি করতেন না। পরে একটা সময় ক্যারিয়ারের শিখরে থাকতে বিনোদন খান্না আধ্যাত্মিক জীবনযাপন শুরু করেন। আমি মনে করি তাঁর মায়ের মৃত্যু এর একটা কারণ। বিনোদ তাঁর মায়ের ভীষণ কাছের ছিলেন। মায়ের মৃত্যুটা তিনি কিছুতেই মানতে পারেননি। আজ বলিউডের স্বপ্নের নায়কের প্রয়াণে অজস্র স্মৃতি ভিড় করছিল। মনে পড়ছিল আন মিলো সজনা র সেটে প্রথম দিনটার কথা। আমার তখন বলিউডে বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে। আর বিনোদের তখন ক্যারিয়ারের শুরুর দিক। ভীষণই লাজুক এবং কম কথা বলতেন। পরে সেই বিনোদই হয়ে উঠেছিলেন সবার মধ্যমণি। হাসি মজায় যেকোনো পরিবেশ বদলে দিতে পারতেন। আর স্পটবয় থেকে শুরু করে সহ-অভিনেতা—সবার সঙ্গে একই রকম সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। অত বড় অভিনেতা হয়েও একদম মাটির মানুষ ছিলেন। অসাধারণ হয়েও সাধারণ জীবনযাপন করতে পারতেন। কখনো বালিশ নিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়তেন। আবার কখনো লুঙ্গি পরে রান্না করতে লেগে যেতেন। সত্যি বলতে, অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি।