খােলা বাজার২৪। শনিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮: প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাস। দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়; কিন্তু সম্প্রতি প্রশ্নফাঁস, সাংবাদিক নির্যাতন, শিক্ষকদের মধ্যে হাতাহাতি, গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মসহ বিভিন্ন অনাকাঙ্খিত ঘটনায় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে গৌরবের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা যদি এ রকম হতাশাজনক হয়, তাহলে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কী হবে; তা বোঝাই যাচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব আরও তলানিতে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নফাঁসের মধ্য দিয়ে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি নজরে আসে। গত ২০ অক্টোবর ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগের দিন রাতেই প্রশ্নের ইংরেজি অংশটি ফাঁস হওয়ার খবর আসে গণমাধ্যমে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে সিআইডি জানায়, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে প্রশ্ন ফাঁস করা হয়েছে। পরীক্ষার আগের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রানা ও আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আটক করা হয়।
প্রশ্নফাঁসে জড়িত সন্দেহে প্রেস কর্মচারী, নাটোরের ক্রীড়া কর্মকর্তা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রসহ ১০ জনকে গত ১৩ ডিসেম্বর বুধবার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ঢাকার ইন্দিরা রোডের একটি প্রেসের এক কর্মচারীর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে আসছিল। এই চক্রকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। গ্রেপ্তারকৃতদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ ও ২০১৬ সালেও ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আর চলতি বছর এই পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতি হয়েছে। খবর আমাদের সময়’র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে শিক্ষকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনায়। গত ২ নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলের সাধারণ সভায় শিক্ষকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। ওই ঘটনায় সিনেট সদস্য ও নীল দলের সদস্য অধ্যাপক ড. আ ক ম জামাল উদ্দিন আহত হয়েছিলেন। বিষয়টি নীল দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান। ঘটনার পর বিচারের দাবিতে অপরাজেয় বাংলার সামনে উভয়পক্ষ পাল্টাপাল্টি মানববন্ধন করে।
বিশিষ্টজনরা বলেন, দলীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্যই শিক্ষকরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। ইতিহাসে এটি একটি লজ্জাকর ঘটনা। ছাত্রদের সামনেই শিক্ষকরা যে ঘটনা ঘটালেন তা শিক্ষকদের আত্মসম্মানবোধের জন্য খুবই শঙ্কাজনক।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে ব্যাপক সমালোচনা হয়। গত সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠে। ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, নুসরাত জাহান, রুহুল আমিন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান এবং অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মাহফুজুল হক মারজানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়। তিন সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা থাকলেও প্রায় তিন মাসেও এর কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম ও নতুন নতুন বিভাগ চালু এবং সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দলীয় রাজনীতির কারণে এবং উপাচার্যের পছন্দের ব্যক্তিকে শিক্ষক নিয়োগ দিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ অহরহ। এমনকি বিজ্ঞপ্তি ছাড়া এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকা প্রার্থীরাও নিয়োগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, গত সাড়ে ৮ বছরে নিজ মেয়াদে ৯০৭ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তার মেয়াদের শেষ তিন বছরে নিয়োগ পেয়েছেন ৩৫০ জন। শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্তত ৭৮ জনকে। এ ছাড়া স্নাতকোত্তর ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন অন্তত তিনজন।
আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নানা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, এটি হতেই পারে। তবে সবকিছুই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী হয়েছে।
এদিকে দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হচ্ছে না। ডাকসু নির্বাচন হোক, তা রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, উপাচার্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এমনকি ক্যাম্পাসে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনগুলোও চায়। তবু বন্ধ রয়েছে নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম মাধ্যম ডাকসু।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, শিক্ষকদের মারামারির সঙ্গে দলীয় স্বার্থ নয়, মূলত ব্যক্তিগত স্বার্থ সম্পৃক্ত। গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি হয়েছে, কারণ এখানে গবেষণায় উৎসাহিত করা হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য গবেষণা ও প্রকাশনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে এগুলোকে উৎসাহিত করা খুবই প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে তার মেধা দেখতে হবে। এর সঙ্গে তার শিক্ষকতার আগ্রহ ও যোগ্যতাকে দেখতে হবে। এখানে উপযুক্ত ব্যক্তিকেই নিয়োগ দিতে হবে। দলীয় বিবেচনা একদম আনা যাবে না।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে শিক্ষাদান উচ্চমানের হতে হবে। এ শিক্ষাদানের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের কর্মসংস্থান ও ভবিষ্যৎ জড়িত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিটি সমস্যার সমাধান আইনি প্রক্রিয়ায় হবে। কেউ উস্কানিমূলক কিছু করলে সেটিও দেখা হবে। তিনি বলেন, কোনো কিছু করার সময় নীতিবোধ, মর্যাদাবোধ এগুলো রেখে করতে হবে। মুখে নীতিকথা বললে হবে না, কাজেও বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। সেটি না ঘটালে অনেক খারাপ ঘটনা ঘটে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক রকম দুষ্টুচক্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে অনেক অপশক্তি জড়িত। কোনো ছোট একটি বিষয় অনেকে বিভিন্ন উস্কানি দিয়ে অনেক বড় করে দেখে; আবার অনেক বড় ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করে। সব অপশক্তিকে কঠিন হাতে দমন করা হবে বলেও হুশিয়ারি দেন আখতারুজ্জামান।